Rafij Khan
Feature Writer And Sub Editor
News Views Media
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম ট্রাম্পকার্ড। গায়ে স্বৈরশাসনের তকমা নিয়ে নব্বইয়ে তার প্রায় দীর্ঘ এক দশকের সামরিক সরকারের পতন হয়। স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও নব্বইয়ে তার সরকার পতনের পর বড় ধরণের কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই রাজনীতি করে গেছেন মৃত্যুর আগ দিন পর্যন্ত। নির্বাচনে ভোট ব্যাংকের খেলায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি দেশের জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে কখনো হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল; আবার কখনো হয়েছে সংসদের অন্যতম বিরোধী দল। নব্বইয়ে এরশাদ ও তার দল দেশের সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনের মুখে পতনের পর বারবারই চেষ্টা করেছে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের। তবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তার কাছে ভোট ব্যাংকের রাজনীতিতে বারবারই পরাজিত হয়েছে তারা। নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের অভাব আন্দাজ করতে পেরে দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় পার্টি শরীক হিসেবে আছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। কিন্তু রাজনৈতিক মাঠে এরশাদ ও জাতীয় পার্টি নব্বই পরবর্তীতে খুব বেশি চমক দেখাতে পারে নি।
আশির দশকে এরশাদ যখন রাষ্ট্রপ্রধান, তখন সে নিজ ক্ষমতায় প্রশাসনকে বিকেন্দ্রিকরনের উদ্দেশে মহাকুমাকে জেলা এবং থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করেছিল। এরশাদের এই উদ্যোগ পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল এবং সর্বমহলে তা প্রশংসিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের এক জনসভায় এরশাদ সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করেন।
এরপর ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাবটিকে প্রধান অঙ্গীকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে এই দাবী আদায়ে এরশাদ ও জাতীয় পার্টি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ ও ২০০৯ সালে এরশাদ পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করে। কিন্তু আশির দশকে সে তার ক্ষমতার জোরে নিজ ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে পারলেও এবার সে সরকার বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদের বাইরে থাকায় তার প্রাদেশিক সরকারের দাবী বারবারই উপেক্ষিত হতে থাকে।
কেমন প্রাদেশিক সরকার চেয়েছিল এরশাদ?
এরশাদের প্রাদেশিক সরকারের রূপরেখার আলোচনা শুরু হয় সেই ১৯৯৮ সাল থেকেই। ২০০৮ সালের দেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। মহাজোটের অন্যতম শরীক এরশাদের জাতীয় পার্টি তখন রাজনৈতিক মাঠে মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থানে। এমন সময়ই দেশের শাসনক্ষমতাকে আরও বিকেদ্রিকরনের উদ্দেশে প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য এরশাদ অনেকটা তোড়জোড় করেই দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানায়। এমনকি ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনকে দাবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাদেশিক সরকারের এই দাবিটিতে আজ পর্যন্ত এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি অনড় অবস্থানে। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে দেশে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নামে দুই স্তর বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এরশাদ সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনারও সুপারিশ করেন।
প্রাদেশিক সরকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এরশাদের কেন্দ্রীয় সরকারের রুপরেখা
এরশাদের প্রাদেশিক সরকার রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডেরাল সরকার। প্রেসিডেন্ট হবে রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হবে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধান। কেন্দ্রীয় সরকারে থাকবে সর্বমোট ৩০০ টি আসন। এই ৩০০ আসন নিয়ে গঠিত হবে জাতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী হবে মন্ত্রী পরিষদের প্রধান। জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল বা জোট কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে। পদত্যাগ বা আস্থা ভোটে পরাজিত না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের মেয়াদ হবে ৫ বছর। আর সরকারি দল বা জোট পদত্যাগ বা আস্থা ভোটে হেরে গেলে সংবিধান অনুযায়ী মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় সংসদে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রনয়ন ও বাজেট পাশ করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়তন ছোট হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে গভর্নর নিয়োগ করবে। তার কাজ হবে প্রাদেশিক সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ। তবে প্রাদেশিক সরকারের যথাসম্ভব স্বায়ত্তশাসন থাকবে। দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী কোনো কাজ না হলে কেন্দ্রীয় সরকার কখনো স্থানীয় সরকারকে হস্তক্ষেপ করবে না। কেন্দ্রীয় রাজধানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয় থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় রাজধানিতে অবস্থিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত উন্নয়ন তহবিল থাকবে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার থেকে এ উন্নয়ন তহবিল গঠিত হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের রূপরেখা
এরশাদের প্রাদেশিক সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী দেশকে ৮ টি প্রদেশে ভাগ করে প্রত্যেক প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হবে। প্রাদেশিক সরকার হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ফেডারেটিং ইউনিট। প্রত্যেক প্রদেশের আলাদা প্রাদেশিক পরিষদ থাকবে। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রাদেশিক পরিষদে জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করলে কোয়ালিয়েশন সরকার গঠিত হতে পারে। প্রাদেশিক সরকারের প্রধান হবে মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মন্ত্রিসভা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে। প্রত্যেক থানা ও উপজেলাকে প্রাদেশিক পরিষদের এক একটি আসন করা যেতে পারে। তবে বড় থানা বা উপজেলাগুলোকে ভেঙ্গে একাধিক আসন করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকবে। প্রাদেশিক সরকারের যেকোনো দুর্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার যথাসাধ্য আর্থিক ও নৈতিকভাবে সাহায্য করবে। থানা ও উপজেলা মিলে প্রদেশের মোট আসন সংখ্যা ৬০০ হতে পারে। প্রত্যেক প্রদেশে আইন শৃঙ্খলার জন্য আলাদা পুলিশি ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু ক্যাডার, কর্মকর্তা, বিচারক, মাজিস্ট্রেট নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। প্রাদেশিক পরিষদের প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার এদের নিয়োগ দিবেন। প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে হাইকোর্ট থাকবে এবং সকল প্রদেশের হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলাকে উন্নয়ন ইউনিটে রুপান্তর করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রাদেশিক সরকার বৈদেশিক বিনিয়োগ ও দাতাদের থেকে উন্নয়ন সহযোগিতা নিতে পারবে। প্রত্যেক প্রাদেশিক রাজধানিতে ছোট আকারে সচিবালয় গঠন করা হবে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন একসাথে হবে। প্রাদেশিক পরিষদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। মেয়াদ পুরনের আগেই কেন্দ্রীয় সরকার ভেঙ্গে গেলেও প্রাদেশিক সরকার বলবত থাকবে। প্রাদেশিক সরকার মেয়াদ পূরণের দুই তৃতীয়াংশ সময়ের আগে বাতিল হলে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত সরকার পূর্ববর্তী সরকারের পাঁচ বছর হতে যে সময় বাকি সেই সময়ের জন্য সরকার পরিচালনা করবে। আর যদি প্রাদেশিক সরকার মেয়াদ পূরণের দুই তৃতীয়াংশ সময়ের পরে বাতিল হয় তবে সেই প্রদেশে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সময় সেই প্রদেশে একসাথে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এলাকাভিত্তিক প্রদেশ গঠন
দেশের তৎকালীন সাতটি বিভাগকে পূর্ণ প্রদেশে রুপান্তর করা এবং বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা নিয়ে নতুন আরেকটি প্রদেশ গঠিত হবার প্রস্তাব দেয়া হয়। ঢাকার আয়তন ছোট হওয়ায় ঢাকা হবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী। তবে ঢাকাকে রাজধানী অঞ্চল হিসেবেও ঘোষণা করা যেতে পারে। মোট ৮ টি প্রদেশগুলোর প্রস্তাবিত নাম হলো উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, বরেন্দ্র প্রদেশ, জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, জালালাবাদ প্রদেশ, চট্টলা প্রদেশ, ময়নামতি প্রদেশ, জাহানাবাদ প্রদেশ, চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ। উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠিত হবে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, দিনাজপুর জেলা নিয়ে। উত্তরবঙ্গ প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী হবে রংপুর। বরেন্দ্র প্রদেশ গঠিত হবে রাজশাহী, নাটোর, নওগা, নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলা নিয়ে। উত্তরবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী হবে রাজশাহী। জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ গঠিত হবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর জেলা নিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী হবে ময়মনসিংহ। জালালাবাদ প্রদেশ গঠিত হবে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলা নিয়ে। জালালাবাদ প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী হবে সিলেট। চট্টলা প্রদেশ গঠিত হবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন জেলা নিয়ে। চট্টলা প্রদেশের রাজধানী হবে চট্টগ্রাম। ময়নামতি প্রদেশ গঠিত হবে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ে। ময়নামতি প্রদেশের রাজধানী হবে কুমিল্লা। জাহানাবাদ প্রদেশ গঠিত হবে খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলা নিয়ে। জাহানাবাদ প্রদেশের রাজধানী হবে খুলনা। চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ গঠিত হবে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ভোলা, বরগুনা জেলা নিয়ে। চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী হবে বরিশাল। প্রদেশের আয়তন অনুসারে প্রতি প্রদেশের আয়তন সংখ্যা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন ঢাকা প্রদেশে যদি ৯০ টি থানা বা উপজেলা থাকে তবে ঢাকা প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের আসন সংখ্যা হবে মোট ৯০ টি। অন্যদিকে সিলেট প্রদেশের মোট উপজেলা যদি ৩৬ টি হয়ে থাকে তবে এর আসন সংখ্যা হবে ৩৬ টি। একইভাবে অন্যান্য প্রদেশের আসন সংখ্যা আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে।
ফেডেরাল সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সম্পর্ক
সকল প্রাদেশিক সরকার সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তবে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রাদেশিক সরকারকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের কর্মকাণ্ড তদারকি করবে। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধিত হবে এবং সংশোধিত সংবিধানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের পালা পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া থাকবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর সমমর্যাদার হবে। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রাদেশিক মন্ত্রীর সমমর্যাদার হবে। কেন্দ্রীয় উপমন্ত্রী প্রাদেশিক প্রতিমন্ত্রীর সমমর্যাদার হবে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সংসদে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ নেতা ও উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপ, বিরোধী দলীয় নেতা ও উপনেতা, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও হুইপ থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকবে প্রতিরক্ষা, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ, শিল্প ও বাণিজ্য, বিমান পর্যটন, নৌ-পরিবহন, শিক্ষা ও জ্বালানির মতো বিষয়। আর প্রাদেশিক পরিষদের অধীনে থাকবে অর্থ, স্বরাষ্ট্র, এলজিআরডি, নারী ও শিশু, ভূমি, খাদ্য, কৃষি, বন ও পরিবেশ, শিক্ষা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির মতো বিষয়। আইন প্রনয়ন বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের মধ্যে মতোবিরোধ দেখা গেলে তা উভয় কক্ষের সম্মতিতে অথবা সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে সমন্বিত করে প্রাদেশিক সরকার স্বাধীনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রদেশের প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের যেকোনো অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে। জেলা ও উপজেলাকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যাস্ত করা হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহকে বিভক্ত করে প্রাদেশিক সরকারের উপর ন্যাস্ত করা হবে।
কেন প্রাদেশিক সরকার প্রবর্তন চেয়েছিল এরশাদ?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ যখন দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানায় তখন সে তার দাবীর পক্ষে নিজের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এমনকি প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটিও গঠন করেন। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি যৌক্তিকতা হল:
বাংলাদেশ আয়তনে ছোট, কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রচুর। তাই দেশের সকল স্থানে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়ার জন্য বৃহৎ আকারে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। আর ক্ষমতা বিকেন্দ্রকরনের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকার ব্যাবস্থা যুগপযুগী। বাংলাদেশের প্রায় সবকিছুই ঢাকা কেন্দ্রিক। এর ফলে দেশের বাকি অঞ্চলগুলো অবহেলিত। দেশের সব জায়গায় সমহারে প্রশাসনিক, শাসনতান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে দরকার প্রদেশিক সরকার ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় সরকারের উপর কাজের চাপ বেশি হওয়ার কাজে নানা ধরণের অসঙ্গতি দেখা যায়। প্রাদেশিক সরকার ব্যাবস্থা প্রবর্তন হলে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ অনেকাংশেই কমে যাবে। এতে করে কাজে সমন্বয় ও দ্রুততা আসবে।
দেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান ও দেশের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। তাই দেশকে প্রদেশ আকারে ভাগ করা হলেও নিজেদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিভাজনের সুযোগ নেই। বরং এতে করে সকল অঞ্চলে কোন রকমের ঝুঁকি ছাড়াই সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধিত হবে। প্রত্যেক প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন সরকার থাকায় এবং প্রতিনিয়ত নির্বাচন হওয়ার প্রাদেশিক রাজনীতিবিদদের মধ্যে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা ফিরে আসবে। তারা তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় দিবে এবং একইসাথে ব্যাপক হারে দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বর্তমানে ক্ষমতা প্রচুর পরিমানে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় জনগন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। এলাকাভিত্তিক প্রদেশ গঠিত হলে প্রত্যেক প্রদেশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠার সম্ভবনা দেখা দিবে। এতে করে দেশের রাজনীতি আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে এবং একইসাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও প্রতিযোগিতা বাড়বে। প্রাদেশিক রাজধানী অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার ব্যাবস্থা ও সুশাসনসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হওয়ায় কেন্দ্রীয় রাজধানীর উপর চাপ কমবে এবং প্রত্যেক প্রদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
প্রাদেশিক সরকার বাবস্থা প্রবর্তিত হলে কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকা বাদে আরও ৮ টি গুরুত্বপূর্ণ বড় শহর গড়ে উঠবে। এতে করে দেশের সর্বস্তরের মানুষ লাভবান হবে।
দক্ষিন এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান , নেপাল , শ্রীলংকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত আছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থার দাবী একেবারে অমূলক নয়। এরশাদের প্রাদেশিক সরকারের দাবির প্রতি নানা সময়ে নানা বিশিষ্টজন এই দাবীর সাথে একাত্মতা পোষণ করেছে। আবার আওয়ামী-বিএনপির মত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এই দাবীর বিরোধিতা করা হয়েছে। তবে দেশের সরকার কাঠামোয় এমন বড় ধরণের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই প্রচুর গবেষণা, আলোচনা-সমালোচনা প্রয়োজন। দাবিটিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে দেশের মানুষের জন্য কতটুক কল্যাণকর হবে সেটা ভেবে দেখা উচিত নয় কি? যদি প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতির বাস্তবায়ন দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে তবে দেশে এই ধরণের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে ক্ষতি কি???
Reference: http://www.jatiyoparty.org
Feature Image: daily-sun.com