Rafij Khan
Feature Writer And Sub Editor
News Views Media
প্রতিটি দেশেই কমবেশি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, সেইসব স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনে বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা কোনো আর্থিক লাভের কথা চিন্তা না করেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে নিজের শ্রম, সময়, অর্থ ও মেধা ব্যয় করে। দেশের ও সমাজের যেকোনো ক্রান্তিকালে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে এই সংগঠনগুলো।
বন্যায় ঘরবারি ভেসে যখন মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়, তখন এইসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো খাবার নিয়ে ছুটে যায়বন্যার্তদের কাছে। তীব্র শীতে যখন দেশের দারিদ্রপীরিত এলাকার মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে কাঁপতে থাকে, তখন সেইসব এলাকায়শীতার্তদের কাছে শীতবস্ত্র নিয়ে ছুটে যায় এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন পরিবেশ নিয়ে অসচেতন, তখন পরিবেশনিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বৃক্ষরোপণ,সামাজিক বনায়নের মতো নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলো। দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী যখন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নিজ উদ্যোগে বিনামূল্যে শিক্ষাদানের মতো কর্মসূচি গ্রহণ করে।মুমূর্ষু কোন রোগীর যখন রক্ত বা প্লাজমার দরকার হয়, তখন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলো নিজ স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে নিজ উদ্যোগে রক্ত বা প্লাজমার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়াও সকল প্রকার সামাজিক সমস্যা সমাধানের অগ্রগামী হিসেবে কাজ করে এইসব স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলো।
সামাজিক সংগঠনে যারা অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা আর্থিকভাবে কোনো লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু তবুও বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝুঁকে পড়ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝুঁকে পরার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
নেতৃত্বদানের গুণাবলী অর্জন
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে দলগতভাবে বহু মানুষ একসাথে কাজ করে। এতে করে সংগঠনের সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়। নানা ধরণের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে একজনের অধীনে অন্যরা কাজ করে। আবার স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটি কাজে অনেক সময় নানা রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা ধীরে ধীরে এইসব প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে ওঠার কৌশল আয়ত্ত করে। স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা অন্যকে প্রভাবিত করে, নিজেকে ও নিজের স্বেচ্ছাসেবী কাজকে অন্যদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এতে করে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের নেতৃত্বদানের গুণাবলী আয়ত্ত করা সহজ হয়।
মানবিক মানুষ হওয়া
মানুষ হয়ে জন্মালেই সকলে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। কারণ প্রকৃত মানুষ হতে হলে অবশ্যই মানবিক হতে হয়, একইসাথে মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হয়। আর মানবিক ও প্রকৃত মানুষ হতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে একজন স্বেচ্ছাসেবী শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, অন্যকে নিয়েও ভাবতে শুরু করে। আত্মকেন্দ্রিকতা ও অর্থলিপ্সার বাইরে যেয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষের জন্য কিছু করার মানসিকতা অর্জন করে। এতে করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা মানবিক মানুষ, প্রকৃত মানুষ হতে পারে।
অবসর সময়কে কাজে লাগানো
সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া সহশিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। তাই একজন স্বেচ্ছাসেবীকে সবসময় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে এমনটি নয়। বরং একজন মানুষ যখন অবসর সময় পাবে তখনই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করবে। এর ফলে একদিকে নিজের অবসর সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাবে। একইসাথে অবসর সময়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ দ্বারা দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে।
উচ্চ শিক্ষায় বাড়তি সুবিধা
দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শুধু পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক পড়াশোনায় পারদর্শী হলেই হয় না। বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ দানের ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক পড়াশোনার বাইরেও সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আর স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবী কাজে অংশগ্রহণ করা সহশিক্ষা কার্যক্রমেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই স্বেচ্ছাসেবী কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত একজন স্বেচ্ছাসেবক বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পায়। এমনকি দেখা যায় যে, অনেক স্বেচ্ছাসেবকের পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক পড়ালেখার ফলাফল খুব বেশি চমৎকার না থাকলেও স্বেচ্ছাসেবী কাজের মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়।
যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করার মাধ্যমে যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করা সহজ হয়। কেননা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করার মাধ্যমে একজন স্বেচ্ছাসেবীকে প্রতিনিয়ত প্রচুর মানুষের সাথে মেলামেশা ও যোগাযোগ করতে হয়। এতে করে স্বেচ্ছাসেবীরা যেমন বাচনিক যোগাযোগের দক্ষতা অর্জন করে তেমনিভাবে অবাচনিক যোগাযোগেও দক্ষতা অর্জন করতে পারে। একজন মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, তার সাথে কী রকম আচরণ করতে হবে, কথা বলার সময় সঠিক অঙ্গভঙ্গি কেমন হতে হবে ইত্যাদি নানা কৌশল খুব সহজেই একজন স্বেচ্ছাসেবক আয়ত্ত করতে পারে। এতে করে একজন স্বেচ্ছাসেবক নিজেকে অন্যদের তুলনায় আলাদা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হিসেবে তুলে ধরতে পারে।ফলে ভবিষ্যৎ চাকুরী জীবনের জন্যও সে অনেক এগিয়ে যায়।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণের সুযোগ
প্রতিবছর শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মানুষ কতো টাকা খরচ করে ফেলে। অথচ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়ে দেশ ও সমাজের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী কাজের প্রয়োজনে দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণও করা যায়। এভাবে একদিকে যেমন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবা করা যায়, অন্যদিকে নিজেদের ভ্রমণের পিপাসাও কিছুটা মিটানো সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিবছর শীতে বহু মানুষ অনেক টাকা খরচ করে দেশের দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যায়। কিন্তু সেই টাকা দিয়েই যদি কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আদলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে শীতবস্ত্র বিতরনের জন্য কিংবা বন্যার সময় বন্যার্তদের সাহায্যর জন্য যাওয়া যায় তবে ভ্রমণও হলো, একইসাথে মানুষের উপকার করাও হলো। তাই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সহজেই দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যায়।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে পরিচয়ের সুযোগ
স্বেচ্ছাসেবী কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের দেশের আনাচে কানাচে ভ্রমণ করতে হয়। এতে করে দেশের নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। একই দেশে অঞ্চলভেদে যে বিভিন্ন ধরনের মানুষের অবস্থান, সেটা সহজেই বুঝতে পারা যায়। দেশের এক জেলার সাথে আরেক জেলা, এমনকি এক উপজেলার সাথে আরেক উপজেলার মানুষের মধ্যেও যে সংস্কৃতিগত সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে সেটা বুঝতে পারা যায়।
অনেকে দেশের বহু স্থান ভ্রমণ করে। কিন্তু সেটা শুধু ভ্রমণের উদ্দেশই। তাই তাদের পক্ষে সেসব এলাকার প্রান্তিক মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয় না। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবকরা দেশের নানা স্থান ভ্রমণ করে সেসব স্থানের প্রান্তিক মানুষের জন্য ভালো কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে। এতে করে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুব সহজেই নানা স্থানের প্রান্তিক মানুষের সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক পার্থক্য সম্পর্কে জানতে পারে এবং এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে বৈচিত্র্য সেটা বুঝতে পারে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন
বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আগে বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখতে হবে। আর জীবনের কঠিন সব বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবী কাজে। একজন স্বেচ্ছাসেবক মাঠ পর্যায়ে কাজ করে জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে একটা পরিবার কতটা নিঃস্ব হতে পারে, ক্ষুধার জ্বালা কতটা তীব্র হতে পারে, শীতে শীতবস্ত্রের অভাবে মানুষ কত কষ্ট করতে পারে, শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে একটা শিশু কতটা পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি বাস্তবতা একজন স্বেচ্ছাসেবকের পক্ষে দেখা ও অনুভব করা সম্ভব হয়। তাই মাঠ পর্যায়ে কাজের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন স্বেচ্ছাসেবক অন্য বহু মানুষের তুলনায় তুলনামুলক বেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী কাজকে অনেকে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ বলে থাকে। সহজ কথায়, অনেকেরই ভ্রান্ত ধারনা এই যে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করলে নিজের কোন লাভই হয় না। অনেকে তো বলে থাকেন, স্বেচ্ছায় সেবামূলক কাজ করা মানেই নিজের সময় নষ্ট করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছাসেবী কাজের মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষের উপকার করা হয় তেমনি নিজেকেও নানা ভাবে বিকশিত করার সুযোগ পাওয়া যায়। তাই সবারই উচিত নিজ সক্ষমতা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হওয়া।
Feature Image Courtesy: shrm.org