Rafij Khan
Feature Writer And Sub Editor
News Views Media
সাল ১৯৪৭। প্রায় দুই শত বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন অবসানের দ্বারপ্রান্তে ভারতীয় উপমহাদেশ। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব তখন চরম পর্যায়ে। হিন্দু ও মুসলমানদের প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে চলছে দর কষাকষি। ১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘোষণার পর ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সম্ভাবনা যত নিকটে আসছিল ততই স্পষ্ট হচ্ছিল যে অখণ্ডিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রায় অনিশ্চিত। স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে ভারতবর্ষকে বিভক্ত হতে হবে। মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব তারই বহিঃপ্রকাশ। ভারতবর্ষের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারতে রেখে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে নতুন দেশ পাকিস্তান গড়ার আহ্বান জানায় তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক মুখপাত্র মুসলিম লীগ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল যেসব অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীর মানুষ প্রায় সমহারে একসাথে বসবাস করে সেসব অঞ্চলের কী হবে? কোথায় যুক্ত হবে সেসব অঞ্চল? ভারতে না পাকিস্তানে? এই নিয়ে দর কষাকষি চলছিল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে। তৎকালীন ভারতবর্ষের এই দ্বিধাবিভক্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। অখণ্ড বাংলা থাকবে না বাংলা বিভক্ত হবে তা নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা কল্পনা। এমতবস্থায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বোঝাপড়ায় ভারতবর্ষের এবং একইসাথে বাংলার বিভক্তি যখন চূড়ান্ত, তখনই তৎকালীন অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম ও অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির বক্তব্যর পরপরই তৎকালীন পশিমবঙ্গের নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পশ্চিম বাংলা প্রদেশ গঠনের দাবি জানায় এবং ভারতের স্বাধীনতার পর পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবার দাবি জানায়। তাদের এই দাবির পক্ষে কলকাতার হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ও বাঙ্গালি অবাঙালী ধনিক গোষ্ঠী এগিয়ে আসে। এমনকি যে কংগ্রেস এতদিন অখণ্ড ভারতের দাবিতে অটল ছিল তারাও ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভক্তি মেনে নিয়ে তাদের ওয়ারকিং কমিটির সুপারিশে তা অন্তর্ভুক্ত করে।
অন্যদিকে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভক্তি মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রতিফলন হওয়ায় তারাও এ দাবি মেনে নেয়। তবে বাংলার ভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বাংলার বেশ কিছু মুসলিম ও প্রগতিশীল নেতা। এদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম অন্যতম। আবুল হাশিম বাংলাকে অখণ্ডিত রাখার প্রস্তাবে ৪৭ এর জানুয়ারিতে শরৎ বসুর সাথে সর্বপ্রথম বৈঠক করেন। এরপর এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের দাবি জানায়। এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক দাবির পর মে মাসে কলকাতায় শরৎ বসুর বাসভবনে বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা বৈঠক করে। পশ্চিমবঙ্গের শরৎ বসুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নেতারা এই দাবির পক্ষে সমর্থন জানায়। কিন্তু মুসলিম লীগ বাংলার খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপের সদস্যরা এই দাবির বিরোধিতা করে এবং এই আলোচনা থেকে বিরত থাকে। মে মাসেই বাংলার কংগ্রেস সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুর অখণ্ড বাংলার দাবিতে একমত হন। মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষে শরৎ বসু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার চুক্তি করে যা ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো উপায়েই বাংলার অখণ্ডতা রক্ষা করা। এই চুক্তিতে বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস লীগ নেতা কিরণ শংকর রায়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
বাংলার অখণ্ডতা বজায় রেখে যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা কী?
এপার বাংলা ও ওপার বংলার মানুষের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে অখণ্ড বাংলার যৌক্তিকতা
বর্তমানে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আরেকটি বর্তমান বাংলাদেশ। তবে এই দুই বাংলার মানুষ ৪৭ সালে এতটাই বিভাজিত ছিল না যে একই বাংলাকে দুই ভাগে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়া যায়। এটা ছিল মূলত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যকার রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ৪৬ এর দাঙ্গার ফলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল এটা সত্য। তাই বলে বাংলা বিভক্তি কখনোই সমাধান ছিল না। কেননা এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দুই অঞ্চলের মানুষেরই মুখের ভাষাও ছিল এক। তাদের মধ্যেকার ধর্ম বাদে সংস্কৃতিগত মিলও রয়েছে প্রচুর। কলকাতা ইংরেজ আমলের রাজধানী হওয়ায় এপার বাংলার মানুষের ওপার বাংলায় যাতায়াত ছিল প্রচুর। একইসাথে এপার বাংলায় যেমন ছিল বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মানুষ, তেমনি ওপার বাংলার ছিল বহু মুসলমান ধর্মাবলম্বীর মানুষ। শুধু ধর্মের বাহানা দিয়ে বাংলাকে খণ্ডিত করার পরিকল্পনা ছিল বেমানান। তাই মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের দলাদলি ও বোঝাপড়ার বাইরে এসে বাংলার স্থানীয় নেতাদের বাংলাকে অখণ্ডিত রাখার দাবি ছিল অনেকটাই যুক্তিযুক্ত।
ঐতিহাসিক কারণে অখণ্ড বাংলার যৌক্তিকতা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলা ঐতিহাসিকভাবেই বহুকাল ধরে একটি আলাদা সত্তা হিসেবে টিকে আসছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের থেকে তারা পৃথক এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হিসেবে প্রকাশ করেছে। এমনকি দীর্ঘ পাঁচশত বছরের পাল আমলেও বাংলা ছিল স্বাধীন সার্বভৌম এক অঞ্চল। ১৩৪২ থেকে ১৫৪৮ সাল পর্যন্তও ভারতবর্ষে বাংলা ছিল স্বাধীন এক সত্তা। এছাড়াও পরবর্তীতে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে জাতীয়তার প্রশ্নে বাংলার হিন্দু মুসলমানের জাতীয় ঐক্যও প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করাকেও অনেক বাঙ্গালি মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। এমনকি হিন্দুদের এক বিরাট অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে। যদিও এতে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। তবুও ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ছিল এক সত্তা, তাই বাংলাকে অখণ্ডিত রেখে যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।
হিন্দু মুসলমানের ঐক্য সৃষ্টিতে অখণ্ড বাংলার যৌক্তিকতা
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা কারণে বাংলার হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, সুদীর্ঘকালের মুসলিম শাসন, ১৯৩৭ এর প্রাদেশিক সরকারকে কেন্দ্র করে মতানৈক্য, ১৯৪০ এ মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব, বিভিন্ন সময়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যকার দাঙ্গা এই দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দেশ বিভাগের পূর্ব মুহূর্তে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যখন বাংলাকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছিল তখন বাংলার হিন্দু মুসলমানদের বাংলার প্রশ্নে একমত হওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। আর তাই তৎকালীন বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একটি অংশ বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলার হিন্দু মুসলমানদের ঐক্য তৈরির ওপর জোর দেয়। আর আগের সব বিভেদ ভুলে বাংলার হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিতভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অখণ্ড বাংলার দাবি ছিল যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় স্বার্থের বাইরে যেয়ে বাংলার স্বার্থ রক্ষায় অখণ্ড বাংলার যৌক্তিকতা
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তিকে তৎকালীন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভাগভাগি বললেও হয়তো খুব বেশি ভুল হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে যেমন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠে, অন্যদিকে ব্রিটিশরাও খুব শীঘ্রই ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যখন ৪৮ এর জুনের মধ্যে ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের শাসনব্যাবস্থা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়, তখনি তৎপর হয়ে উঠে তৎকালীন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা। ব্রিটেন থেকেও বলা হয় যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যদি অতিসত্বর নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় তবে ব্রিটেন সরকার প্রাদেশিক সরকারের হাতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হবে। এমতবস্থায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের স্বার্থের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত ছিল। মুসলিম লীগ আগে থেকেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ ছিল। অন্যদিকে কংগ্রেস মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতার কারণে ভারত, একইসাথে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তির পক্ষেও মুসলিম লীগের সাথে সম্মত হয়। অথচ বাংলার স্থানীয় অনেক প্রাদেশিক নেতাই বাংলা বিভক্তির পক্ষে ছিল না। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় স্বার্থে বাংলার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এমতবস্থায় বাংলার বেশ কিছু প্রাদেশিক নেতা যে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব করেছিল তা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লবভাই প্যাটেল সহ কেন্দ্রীয় প্রায় সকল নেতাই বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। এমনকি আবুল হাশিম, শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গেলেও গান্ধী প্রস্তাবটি এড়িয়ে যান এবং পরবর্তীতে শরৎ বসুকে চিঠি লিখে যুক্ত বাংলার প্রস্তাব থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক উভয় কারণেই ভারতের পূর্বাঞ্চলে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হোক সেটা তারা চান নি। একইসাথে ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ছিল ভারতবর্ষের রাজধানী। তাই অখণ্ড স্বাধীন বাংলা হলে ভারত কলকাতার মত গুরুত্বপূর্ণ নগরী হারাবে। অন্যদিকে আসাম যদি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে এর সাথে রেলপথে মূল ভূখণ্ডে যোগাযোগের কোনো ব্যাবস্থা থাকবে না এবং ভারতীয় ইউনিয়ন আসামের বিপুল পরিমান পেট্রোল ও খনিজ সম্পদ হারাবে। এমনকি কংগ্রেসের হাই কমান্ড এও ধারনা করেছিল যে, বাংলাকে বিভক্তি করলে পূর্ব বাংলা খুব বেশিদিন ভু-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে একা টিকে থাকতে পারবে না। তাই সুদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলা ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতেই বাধ্য হবে।
মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া
দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরিপন্থী হওয়ায় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে অখণ্ড বাংলা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ প্রথমে অখণ্ড বাংলার পক্ষে থাকলেও বসু-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠার চুক্তির পর সে এর বিরোধিতা করতে থাকে। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশে যুক্ত করার দাবি জানায় এবং যুক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তবে যুক্ত স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব সম্পর্কে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অবস্থান ঠিক কী ছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় নি। জিন্নাহের অনুগত হাসান ইস্পাহানীর মতে, যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠায় সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর সমর্থন পায় নি। অন্যদিকে বঙ্গীয় লীগ নেতা মাওলানা রাগীব আহসান বলেন, যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠায় সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহের সমর্থন পেয়েছিল। আবার আরেক নেতা হোসেন ইমাম বলেন, গান্ধী ও কংগ্রেসের মত পেলে জিন্নাহ এ ব্যাপারে মত দিবে বলে সোহরাওয়ার্দীকে জানিয়েছিল। তবে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তির ব্যাপারে জিন্নাহ সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও জিন্নাহ তাদের যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি পছন্দ করতেন না, কেননা তা ছিল মূলত দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরিপন্থী।
হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া
হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ও নানা রাজনৈতিক কারণে অনেক হিন্দু যে বাংলা বিভক্তির পক্ষে ছিল সে কথা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বণিক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলা বিভক্তির দাবি করেছিল। অথচ তারাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। অমৃতবাজার পত্রিকার এক জরিপ অনুযায়ী, ৯৮.৩ শতাংশ হিন্দু ছিল বাংলা বিভক্তির পক্ষে আর ০.৬ শতাংশ হিন্দু ছিল বাংলার অখণ্ডতার পক্ষে ছিল। কিন্তু এই জরিপ সঠিক ছিল না। কেননা পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই যুক্ত বাংলাকে সমর্থন করেছিল এবং তারা ছিল তৎকালীন হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক। কিন্তু কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের মিলিত প্রচারণা বাংলার হিন্দুদের ব্যাপকভাবে বিভক্ত বাংলার পক্ষে প্রভাবিত করেছিল, এ কথা মানতেই হবে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
যুক্ত বাংলা প্রস্তাব সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ ও ভারত সচিব লিস্টওয়েল অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা দানের পক্ষপাতি ছিল। কিন্তু ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথমে এ দাবির পক্ষে সমর্থন দেন নি। পরবর্তীতে বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজের প্রচেষ্টায় ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা দানে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে কংগ্রেসের অনীহা ও সময় সংক্ষিপ্ততার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই দাবি আলোচনা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন।
ফজলুর হকের ভূমিকা
শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক ছিলেন বাংলার গণমানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবিদ। এমনকি কলকাতায়ও তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৪০ সালের মূল লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথাও সে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন লাইমলাইটের বাইরে। যদিও আগে তিনি বাংলা বিভক্তির কথা বলেছিলেন, কিন্তু ‘৪৭ এ বাংলা বিভক্তি ইস্যুতে সে নিস্ক্রিয়তা পালন করে। সত্যিকার অর্থে ‘৪৭ এর সময়ে ফজলুর হক রাজনীতির মাঠে তার স্থান ধরে রাখতে পারেন নি। একইসাথে তার প্রতিষ্ঠিত কৃষক প্রজা পার্টিও তখন প্রায় অস্তিত্বহীন। তাই অনেকটা হতাশাগ্রস্থ হয়েই এই সময়টায় সে রাজনীতির বাইরে ছিলেন এবং বাংলা বিভক্তির প্রশ্নে কোনো মত দেন নি।
যুক্ত বাংলা প্রস্তাব কেন ব্যর্থ হল?
সময় ও দূরদর্শিতার অভাব
যুক্ত বাংলার প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম মূল কারণ ছিল বিলম্বিত উদ্যোগ। ১৯৪৭ স্বাধীনতার প্রশ্নে পুরো ভারতবর্ষ যখন টালমাটাল তখন রাজনৈতিক বিভাজন, হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বকে পেছনে ফেলে যুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য যে জনমত গড়ে তোলা দরকার সে পর্যাপ্ত সময় হাতে ছিল না। একদিকে ব্রিটিশ সরকার যত জলদি সম্ভব ক্ষমতা বুঝিয়ে চলে যাবার পথ খুঁজছিল, অন্যদিকে কংগ্রেসে ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত ছিল। তাই স্বাধীন যুক্ত বাংলা গড়ার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় মহলে আলোচনার সুযোগ পায় নি। অনেকের মতে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার তৃতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের মতো বড় দাবি ভারতের স্বাধীনতা লাভের আরও কয়েক বছর আগে থেকেই তুলে ধরা দরকার ছিল। এতে করে বাংলার তৃণমূলে জনসমর্থন, প্রদেশের নেতাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচনা করার সুযোগ হত। বসু-সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলার প্রস্তাবে যথেষ্ট যৌক্তিকতা থাকলেও সময় সল্পতা ও দূরদর্শিতার অভাবে যুক্ত বাংলার স্বপ্ন অধরাই হয়ে যায়।
মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যেকার অনৈক্য
স্বাধীন যুক্ত বাংলা দাবির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তৎকালীন বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ফলপ্রসু কোনো আলোচনাই হয় নি। এমনকি বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নিজেরাই ছিল দ্বিধাবিভক্ত। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ মনেপ্রাণে অবিভক্ত বাংলার জন্য দাবি জানিয়ে আসলেও খাজা গ্রুপ স্বাধীন অখণ্ডিত বাংলার বিরোধিতা করে। খাজা গ্রুপের সাথে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ও জিন্নাহর ভালো সম্পর্ক থাকায় সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের যুক্ত বাংলার দাবি প্রদেশ পর্যায়ে এসেই চাপা পরে যায়। অন্যদিকে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড কোনোভাবেই পশ্চিম বাংলা, বিশেষ করে কলকাতা ও আসাম হারাতে চায় নি। তাই বসু-সোহরাওয়ার্দী দাবির প্রথম থেকেই কংগ্রেসের হাই কমান্ড তথা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লবভাই প্যাটেল, কিরণ শংকর রায় প্রমুখের বিরোধিতা ছিল। আর দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের হাই কমান্ড যখন এই দাবি নিয়ে উদাসীন, তখন এই দাবির বাস্তবায়ন অনেকটা অলীক কল্পনাই।
কম্যুউনিস্ট ও হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা
তৎকালীন ভারতের কম্যুউনিস্ট ও হিন্দু মহাসভা পাল্লা দিয়ে যৌথ বাংলার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। হিন্দু মহাসভা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে খুব জোরেশোরেই পশ্চিম বাংলাকে ভাগের দাবি জানায়। একইসাথে হিন্দু মহাসভা কলকাতার বণিক গোষ্ঠী, হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা ও হিন্দু এলিট সম্প্রদায়ের মাঝে বাংলা বিভক্তির প্রচারণা চালায়। এতে করে বাংলায়, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাগের পক্ষে জনসমর্থন তৈরি হয়। অন্যদিকে ভারতের কম্যুউনিস্ট পার্টি একদিকে যেমন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পক্ষে কথা বলেছে অন্যদিকে তারা তাদের পার্টির পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’ এক সংখ্যায় লিখেছিল যে, বাংলা হবে বৃহৎ বাংলা যেখানে মুসলমানেরা হবে সংখ্যালঘু। কম্যুউনিস্ট পার্টির এই ধরণের প্রচারণার ফলে বাংলার মুসলমানেরা এক ধরণের অস্তিত্ব সংকটে পরে যায়। এর ফলে বাংলার কিছু মুসলমান শরৎ বসু, আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দীর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।
চুক্তির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা
আগেই বলা হয়েছে, বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি ও যৌথ বাংলা প্রস্তাবের দাবি করা হয়েছিল অনেকটা দেরিতে। তাই এই চুক্তিতে যৌথ বাংলার যে রূপরেখা দেয়া হয়েছিল তাতে অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়ে গিয়েছিল। এমনকি চুক্তির প্রস্তাবগুলো শরৎ বসু নিজে করেন, নাকি সোহরাওয়ার্দী করেন, নাকি দুজনে মিলে করেন এ বিষয়েও সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। জনশ্রুতি রয়েছে, শরৎ বসু নিজে এই প্রস্তাবগুলো লিখে এনে বৈঠকে পেশ করেছিলেন এই শর্তে যে, যদি বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এই দাবিগুলো মেনে নেয় তবেই তিনি অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দিবেন। চুক্তির প্রস্তাবগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর দৈনিক আজাদ মন্তব্য করে যে, শরৎ বসু যেহেতু অখণ্ড বাংলা চান না তাই এই আন্দোলন থেকে কৌশলে সরে যাওয়ার দরুন কিছু জটিল প্রস্তাব করছিল।
প্রশাসনিক কারণ ও হিন্দু-মুসলমান বিভাজন
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশক বাংলার প্রশাসনে মুসলিমদের আধিপত্য বজায় ছিল। এতে করে বাংলার কংগ্রেস ও হিন্দু এলিট গোষ্ঠীর মুসলমানদের প্রতি এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল। অখণ্ড ভারতে হিন্দুরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের থেকে পিছিয়ে পরবে বলে তাদের ভেতরে একটা ভয় ছিল। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলা খনিজ সম্পদে বেশি সমৃদ্ধ ছিল। পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও এলিট গোষ্ঠী বুঝেছিল যে, অখণ্ড বাংলার থেকে খণ্ডিত বাংলায়ই তারা বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তাই পশ্চিম বাংলার হিন্দু এলিট গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ ও অনেক হিন্দু অখণ্ড ভারতের থেকে খণ্ডিত ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
যুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনে যে মানুষটা প্রথম থেকে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সময় স্বল্পতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, দূরদর্শিতার অভাব, মুসলিম লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বসহ শত বাধা বিপত্তি অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেছিল ভারত পাকিস্তান বৃত্তের বাইরে যেয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বাঙ্গালীদের ঐক্যবদ্ধভাবে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব ও বহু রাজনৈতিক নেতার ব্যাক্তি স্বার্থ হাসিলের কারণে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রস্তাব ভেস্তে যায়। তবে ভারত পাকিস্তান বিভক্তের আগ দিন পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী তার চেষ্টা চালিয়ে যান। হয়তো জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সমীকরণের কারণে অখণ্ড বাংলাকে স্বাধীন করা যায় নি, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার এই যুক্তিযুক্ত, যুগপোযুগী ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কারণে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এপার ও ওপার বাংলার মানুষের মনে!
Feature Image Courtesy: mizpahed.com
Reference Books:
- Muslims Politics in Bengal (Shila Sen)
- আমার জীবন ও বিভাগ পূর্ব বাংলার রাজনীতি (আবুল হাশিম)
- বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস (এম.এ. রহিম)
- ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন (মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক)