ফেসবুক: বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

Rafij Khan

Feature Writer And Sub Editor
News Views Media

ফেসবুক নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আজকাল এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন যার একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। আবার অনেকেই আজকাল ইন্টারনেট বলতে শুধু ফেসবুকই বুঝে থাকে। যদিও বর্তমানে ফেসবুকের মতো আরো অনেক অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে তাও ফেসবুকের আধুনিক ফিচার, সহজলভ্যতা এবং নির্ভরযোগ্যতার কাছে অন্য সাইটগুলো খুবই তুচ্ছ। তাইতো বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দুইশ সত্তর কোটির মতো লোক ফেসবুক ব্যবহার করে।

বিশ্ব-সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার ফেসবুক একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। যার ইন্টারনেটে প্রবেশ করার সক্ষমতা রয়েছে সে এটিতে ফ্রি সদস্য হতে পারে। ফেসবুকের মালিক হলো ফেসবুক ইনক কোম্পানি। ফেসবুক ব্যবহারকারীগণ ফেসবুকে বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী হালনাগাদ ও আদান প্রদান করতে পারেন। একইসাথে ফেসবুক ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী শহর, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অঞ্চল-ভিক্তিক নানা নেটওয়ার্কেও যুক্ত হতে পারেন। 

ফেসবুকের সদর দপ্তর; Image Courtesy: aclunc.org

একনজরে ফেসবুকের খুঁটিনাটি

সাইটের নাম : facebook.com

সাইটের ধরন : সামাজিক যোগাযোগ পরিষেবা

সংস্থাপিত : ক্যামব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

প্রতিষ্ঠাকাল : ফেব্রুয়ারি ৪, ২০০৪

সদর দপ্তর : পাওলো আলটো, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

এরিয়া সার্ভ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (২০০৪–০৫), বিশ্বব্যাপী (২০০৫–বর্তমান)

প্রতিষ্ঠাতা : Mark Zuckerberg, Eduardo Saverin, Andrew McCollum, Dustin Moskovitz, Chris Hughes

Key people : মার্ক জুকারবার্গ (চেয়ারম্যান এবং সিইও), শেরিল স্যান্ডবার্গ (সিওও)

শিল্প : ইন্টারনেট ভিত্তিক

সহায়ক প্রতিষ্ঠান : Instagram, WhatsApp

যে ভাষায় লিখিত : সি++ ও পিএইচপি

ব্যবহারকারী : প্রায় ২৭০ কোটি উপলব্ধ ভাষাসমূহ : বহুভাষিক (প্রায় ১৪০ টি)

ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য নীল রঙের; Image Courtesy: theguardian.com

ফেসবুক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ফেসবুক একটি সামাজিক নেটওয়ার্কিং সেবা যা ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মার্ক জুকারবার্গ যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তখন তার কক্ষনিবাসী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিত্স এবং ক্রিস হিউজেসের সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। মার্ক জুকারবার্গ হার্ভার্ডে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত সময়ে অক্টোবর ২৮, ২০০৩ সালে ফেসবুকের পূর্বসূরি সাইট ফেসম্যাস তৈরি করেন। ফেসম্যাসে হার্ভার্ডের ৯ টি হাউসের শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করেন এবং দুইটি করে ছবি পাশাপাশি করে হার্ভার্ডের সব শিক্ষার্থীদের দেখান। এরপর তিনি ভোট দিতে বলেন কোন ছবিটি হট আর কোনটি হট নয় অর্থাৎ ‘হট অর নট’। জানা যায় যে, এই প্রতিযোগিতার তথ্য সংগ্রহের জন্য মার্ক জুকারবার্গ হার্ভার্ডের সংরক্ষিত তথ্য কেন্দ্রে বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করেন বা হ্যাঁক করেন। ফেসম্যাস সাইটে মাত্র ৪ ঘণ্টায় ৪৫০ ভিজিটর ২২০০০ ছবিতে অনলাইনের মাধ্যমে ভোট দেন।

ফেসবুকের সহ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ; Image Courtesy: news.harvard.edu

অতঃপর ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে মাসে ফেসম্যাস হতে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্ক জুকারবার্গ তার নতুন সাইটের কোড লেখা শুরু করেন এবং ফেব্রুয়ারিতে হার্ভার্ডের ডরমিটরিতে দি ফেসবুক.কম এর শুভ উদ্বোধন করেন। শীঘ্রই মার্ক জুকারবার্গের সাথে যোগ দেন ডাস্টিন মস্কোভিৎজ (প্রোগ্রামার), ক্রিস হুগেস ও এডোয়ার্ডো স্যাভেরিন (ব্যবসায়িক মুখপাত্রও) এবং অ্যান্ডরু ম্যাককলাম (গ্রাফিক্ আর্টিস্ট)। প্রথমে ফেসবুকের সদস্যপদ প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড ছাত্রদের প্রতিষ্ঠাতা দ্বারা সীমিত থাকলেও পরে বস্টন অঞ্চলে অন্যান্য কলেজগুলিতে, আইভি লীগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেসবুক সম্প্রসারিত হয়।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকালীন ভিউ; Image Courtesy: medium.com

ধাপে ধাপে ফেসবুকের অগ্রযাত্রা ও জয়জয়কার

২০০৪ সাল

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে ফেসবুকের যাত্রা শুরু thefacebook.com নামের ওয়েবসাইট দিয়ে। সে সময় ফেসবুকে শুধু লেখা এবং কোনো ব্যাক্তির প্রোফাইলে কিছু বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। একই বছরের জুনে প্যালো আল্টোতে ফেসবুকের অফিস নেওয়া হয় ও ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছায়।

২০০৫ সাল

২০০৫ সালের আগস্টে ‘দ্য ফেসবুক ডটকম’ নাম পাল্টে কোম্পানির নাম রাখা হয় শুধু ‘ফেসবুক’। ঐ বছরের অক্টোবরে ফেসবুকে ছবি আপলোড এবং শেয়ার সিস্টেম চালু হয়। ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় ৫৫ লাখ। এ বছরই ফেসবুক নামে ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করতে সাইটটি খরচ করে ২ লাখ মার্কিন ডলার

২০০৫ সালে ফেসবুকের ভিউ; Image Courtesy: cnet.com

২০০৬ সাল

২০০৬ সালের এপ্রিলে মোবাইলের জন্য ফেসবুক চালু হয় ও প্রথম নিউজ ফিড ফিচার চালু করা হয়। সে বছর প্রাক্তন সহপাঠী এবং বন্ধুদেরকে খুঁজে বের করার জন্য ফেসবুক সার্চ বক্স চালু করে যার ফলে ফেসবুক আরও বেশি জনপ্রিয়তা পায়। ১৩ বছরের উপরে যে কারো জন্য ফেসবুক উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অক্টোবরে কৌশলগত কারণে ফেসবুক মাইক্রোসফটের সাথে চুক্তি করে। ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ২০ লাখে।

২০০৭ সাল

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক ভার্চুয়াল গিফট শপ সেবা চালু করে। এ বছরই প্রথমবারের মতো ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করার এবং ভিডিও চালু করার সুবিধা যুক্ত হয়। এপ্রিলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা পৌঁছায় দুই কোটি। এ বছর মাইক্রোসফটের MSN Messenger কে টেক্কা দেয় ফেসবুক। শেষমেশ MSN Messenger বিলুপ্ত হয়ে যায়।

২০০৭ সালে ফেসবুকের ভিউ; Image Courtesy: cnet.com

২০০৮ সাল

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানাডা ও ব্রিটেনের পর ফ্রান্স ও স্পেনে ফেসবুকের ব্যবহার শুরু হয় যা ফেসবুককে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এপ্রিলে ফেসবুক চ্যাট ও মেসেঞ্জার চালু হয় ও আগস্টে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটিতে। এ বছরে ফেসবুক তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী MySpace কে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।

২০০৯ সাল

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় ১৫ কোটি। সে বছরই ফেসবুক প্রথম লাইক, কমেন্ট ও ট্যাগের সুবিধা চালু করে। এ বছরের শেষ দিকে ফেসবুকের সর্বমোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় ৩৫ কোটি।

২০০৯ সালে ফেসবুকের ভিউ; Image Courtesy: cnet.com

২০১০ সাল

২০১০ সালের জুলাইয়ে ফেসবুকের মোট ব্যবহারকারী ৫০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ফেসবুকের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফিচার চেকইন, ফেস রিকগনিশন, ফটো ও ট্যাগিং সুবিধা যুক্ত হয়। কম্পিউটার এবং মোবাইল ভার্শনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তার দিকে জোর দিতে থাকে ফেসবুক।

২০১১ সাল

২০১১ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুকের মার্কেট ভ্যালু ৫০ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হয়। এ বছর ফেসবুক তার ডিজাইনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, চ্যাটে ভিডিও কলিং সুবিধা চালু করে এবং বাগ বাউন্টি প্রোগ্রাম চালু করে। এ বছর থেকেই যেকোনো ব্যবহারকারীর টাইমলাইনে গিয়ে তার সর্বশেষ শেয়ার করা স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও, লিংক থেকে শুরু করে পেছনের দিকে তার ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশনের দিন পর্যন্ত সব পোস্ট সবকিছু দেখার সুযোগ হয়।

২০১২ সাল

২০১২ সালে ফেসবুকের মোট ব্যবহারকারী দাড়ায় ১ বিলিয়নে। ফেসবুক বর্তমান বিশ্বের ১ নম্বর ফটো শেয়ারিং অ্যাপ ইন্স্টাগ্রামকে সে বছর কিনে নেয় মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। এ সময় থেকেই ফেসবুকে বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন ভিত্তিক স্পনসর্ড স্টোরি ব্যবহারকারীর সামনে হাজির হতে থাকে।

২০১২ সালে ফেসবুকের ভিউ; Image Courtesy: cnet.com

২০১৩ সাল

২০১৩ সালে ফেসবুক internet.org নামে একটি বিনামূল্যের ওয়েবসাইট লঞ্চ করে। জুনের ১২ তারিখে ফেসবুক টুইটারের মতো হ্যাশট্যাগ ও কমেন্টের নিচে রিপ্লাইয়ের সুযোগ চালু করে।

২০১৪ সাল

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক বর্তমানের অন্যতম আরেকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপকে কিনে নেয়। হোয়াটসঅ্যাপের নির্মাতা ছিলেন দুজন প্রাক্তন Yahoo কর্মকর্তা। ১৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৪ বিলিয়ন তাদেরকে দেওয়া হয় এবং বাকি ১২ বিলিয়ন ফেসবুকের শেয়ারে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ বছর ফেসবুক ভিডিওতে ভিউ কাউন্ট ও সেভ সুবিধাটি চালু করা হয়।

২০১৫ সাল

২০১৫ সালে থেকে ফেসবুক ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল, GIF ফরম্যাটের অ্যানিমেটেড ছবি সাপোর্ট ও ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও সুবিধা চালু করে। এছাড়া এ বছরই ফেসবুক নস্টালজিক ‘অন দিস ডে’ ফিচার চালু করে। এ বছর থেকে প্রতিদিন সক্রিয়ভাবে ১০০ কোটি মানুষ ফেসবুকে বিচরণ করতে থাকে।

২০১৬ সাল

২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ফেসবুক লাইভ ফিচারটি চালু হয়। লাইভে আসা প্রথম ব্যাক্তিটি হলেন মার্ক জুকারবার্গ নিজেই। এছাড়াও এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লাইকের পাশাপাশি অন্যান্য রিয়েক্ট বাটন চালু হয়।

২০১৭ সাল

২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুক দুইশ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর মাইলফলক অতিক্রম করে।

ফেসবুকের বর্তমান পিসি ভিউ; Image Courtesy: about.fb.com

ফেসবুকের মালিকানা

ফেসবুকের মালিকানার মধ্যে মার্ক জুকারবার্গ ২৮%, এক্সেল পার্টনার্স ১০%, ডিজিটাল স্কাই টেকনোলোজিস ১০%, ডাস্টিন মস্কোভিটজ ৬%, এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন ৫%, শণ পার্কার ৪%, পিটার থিয়েল ৩%, গ্রেলক পার্টনার্স এবং মেরিটেক ক্যাপিটাল পার্টনার্স ১ থেকে ২% প্রত্যেকে, মাইক্রোসফট ১.৫%, লি কা-শিং ০.৮%, ইন্টারপাবলিক গ্রুপ ০.৫ এর কম, বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মচারি এবং বিভিন্ন তারকা (নাম অপ্রকাশিত) প্রত্যেকে ১% এর কম এবং বাঁকি ৩০% বিভিন্ন কর্মচারি ও অপ্রকাশিত তারকাদের মালিকানাধীনে রয়েছে।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, ২০০৮ সালের মে মাসে ফেসবুকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা অ্যাডাম ডি’ অ্যাঞ্জেলো ফেসবুক থেকে পদত্যাগ করেন। ধারনা করা হয় যে, মার্ক জুকারবার্গ এর সাথে তার দ্বন্দ্ব চলছিল এবং তিনি ফেসবুকের আংশিক মালিকানার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এ সিদ্ধান্ত নেয়।

ফেসবুকের বর্তমান লগইন পেইজ; Image Courtesy: tangent.com

ফেসবুকের ফিচারসমুহ

প্রোফাইল: ফেসবুক ব্যবহারকারী খুব সহজেই নিজের প্রোফাইলে নিজের ছবি ও অন্যান্য তথ্য নিয়ে নিজেকে অন্যর কাছে ভার্চুয়াল জগতে তুলে ধরতে পারে। এতে তার স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও ও নিজ সম্পর্কে নানা তথ্য সুজজ্জিত অবস্থায় থাকে এবং সবাই তা প্রাইভেসি সেটিং অনুযায়ী দেখতে পারে।

নিউজ ফিড: ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল ছাড়াও নিজস্ব নিউজ ফিড থাকে যেখানে সে তার সাথে যুক্ত বন্ধু-বান্ধব, গ্রুপ বা পেইজের ছবি-স্ট্যাটাস ও নানা আপডেট সম্পর্কে জানতে পারে। এছাড়াও পছন্দের সেলিব্রেটি-তারকাদের আইডি ও পেজের আপডেটও নিউজ ফিডে দেখা যায়।

ফ্রেন্ডস: ফেসবুকে ব্যক্তিগত বা পেশাদাগতভাবে পরিচিত অপর ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সাথে ‘ফ্রেন্ড’ নামক ফিচারের মাধ্যমে সহজেই যুক্ত হওয়া যায় এবং তাঁদের সম্পর্কে নিউজ ফিডে আপডেট দেখা যায়। এছাড়াও ‘ফ্রেন্ড’ হিসেবে যুক্ত সবার সাথে ভিডিও-অডিও বা টেক্স মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়।

লাইক ও রিঅ্যাকশন: ফেসবুকে অন্যর ছবি, ভিডিও ও স্ট্যাটাসে লাইক ও নানা ধরনের রিঅ্যাকশন দিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া জানানো যায়। লাইক ছাড়াও অন্যান্য রিঅ্যাকশনের মধ্যে আছে ‘হাহা’, ‘ওয়াও’, ‘সেড’, ‘লাভ’ ও ‘অ্যাংরি’।

ফেসবুকে রয়েছে লাইক ও নানা রকম রিঅ্যাকশন ফিচার; Image Courtesy: marketingland.com

কমেন্ট: ফেসবুকে ভিডিও, ছবি বা স্ট্যাটাসে লাইক-রিঅ্যাকশনের পাশাপাশি কমেন্ট করেও বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানানো যায়। ইদানীং কমেন্টের রিপ্লাই ও কমেন্টে লাইক-প্রতিক্রিয়াও দেয়া যায়।

চ্যাট: ফেসবুকে নিজের সাথে যুক্ত সবার সাথে টেক্সট মেসেজ দিয়ে কথোপকথন করা যায়। এছাড়াও টেক্সট মেসেজের পাশাপাশি চ্যাটে অডিও-ভিডিও, ফাইল ও ছবিও পাঠানো যায়।

গ্রুপ চ্যাট: ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছাড়াও ফেসবুকে সমগোত্রীয় অনেকে একইসাথে একই চ্যাট বক্সে কথোপকথন করা যায়। গ্রুপ চ্যাটের ক্ষেত্রেও সাধারণ চ্যাটের মতো একই সুবিধা পাওয়া যায়। আজকাল একদলীয় অনেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা একই গ্রুপ চ্যাটেও করে থাকে।

ভয়েস কল: ফেসবুকের আকর্ষণীয় আরেকটি ফিচার হলো ভয়েস কল। আগে ভয়েস কলের জন্য শুধু মোবাইল সিমের উপর নির্ভর করতে হতো। এখন ফেসবুকের সাথে পরস্পর যুক্ত থাকলে খুব সহজেই ভয়েস কলে কথা বলা যায় যা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।

ফেসবুকে অডিও ভিডিও কল করা যায়; Image Courtesy: techcrunch.com

ভিডিও কল: কিছুদিন আগেও ভিডিও কলের জন্য স্কাইপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ফেসবুকেই ব্যক্তিগত চ্যাটে ও গ্রুপ চ্যাটে ভিডিও কল করা যায়।

ছবি আপলোড: ফেসবুকের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিচার হচ্ছে ছবি আপলোড করা। ফেসবুকে খুব সহজেই ছবি আপলোড করা যায় যা নিজের সাথে যুক্ত অন্যান্য ফেসবুক ব্যবহারকারী দেখতে পারে এবং লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করতে পারে।

ভিডিও আপলোড: ফেসবুকে খুব সহজেই ছবির পাশাপাশি ভিডিও আপলোড করা যায় এবং ছবির মতই ভিডিওতে নিজের সাথে যুক্ত অন্যান্য ব্যবহারকারী দেখতে পারে এবং লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করতে পারে।

ইমোজি: ফেসবুকে চ্যাটে ও কমেন্টে নিজের মনোভাব আরও বিস্তরভাবে বুঝানোর জন্য নানা ধরনের ইমোজি ব্যবহার করা হয়। 

ফেসবুকে নানা ধরণের ইমোজি ব্যবহার করা যায়; Image Courtesy: emojipedia.org


নোট:
 ফেসবুকে যেকোনো বিষয়াদি নোট আকারে প্রকাশিত ও সংরক্ষণ করা যায় এবং তার সাথে ইচ্ছেমত ছবি ও ভিডিও যুক্ত করা যায়।

নোটিফিকেশন: ফেসবুক ব্যবহারকারী নতুন কোনো তথ্য নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জানতে পারে। কেউ ছবি, ভিডিও বা স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট করলে বা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলে তা ব্যবহারকারীকে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জানানো হয়।

ইভেন্ট: বাস্তবিক জীবনের কোনো ইভেন্টকে অনলাইনে প্রচার করতে এবং ইভেন্টের সাথে অন্যদের যুক্ত করতে ফেসবুকে ইভেন্ট নামের একটি ফিচার রয়েছে। এর মাধ্যমে ইভেন্টের যাবতীয় তথ্য সকলের কাছে তুলে ধরা সহজ হয়।

লাইভ স্ট্রিমিং: ফেসবুক ব্যবহারকারী এই ফিচারটি ব্যবহার করে খুব সহজেই ফেসবুক লাইভে আসতে পারে এবং লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো কিছু প্রকাশ করতে পারে।

ফেসবুকের রয়েছে লাইভ স্ট্রিমিং সুবিধা; Image Courtesy: wowza.com

পেজ: ফেসবুকে নিজস্ব আইডির পাশাপাশি নিজস্ব পেজও খোলা যায়। বিশেষ করে ই-কমার্সের জন্য এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিরা ফেসবুকে পেজ খুলে নিজেদের প্রচারনা করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফেসবুকে নিজস্ব পেজ থাকে।

ভার্চুয়াল মুদ্রা: ফেসবুক সম্প্রতি বিট কয়েনের মতো নিজস্ব ভার্চুয়াল মুদ্রা লিব্রা চালু করেছে। যদিও এর নিরাপত্তা ও যথাযথ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে।

ফেসবুক ডেটিং: ফেসবুকে ডেটিং সেবা বা ম্যাচমেকিং ফাংশন নামের নতুন একটি ফিচার যুক্ত হয়েছে যা দ্বারা ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজেদের পছন্দমত অনলাইনে সঙ্গী বেছে নিয়ে বাস্তবিক জীবনে ডেট করতে পারবেন।

অন দিস ডে: ফেসবুকে পুরনো দিনের ছবি, ভিডিও, স্ট্যাটাস স্মরণ করিয়ে দেয় ‘অন দিস ডে’ ফিচারটি। একে ফেসবুক মেমরিও বলা হয়।

জন্মদিনের শুভেচ্ছা: ফেসবুকে নিজের সাথে যুক্ত ফ্রেন্ডের জন্মদিন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মনে করিয়ে দেয়া ও জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আলাদা ফিচার রয়েছে।

ফেসবুক গ্রুপ: ফেসবুকে নির্দিষ্ট কমিউনিটিকে একসাথে যুক্ত রাখতে ও তাঁদের মধ্যে সহজভাবে তথ্য ও ভাবের আদান-প্রদান করতে ফেসবুকে আলাদা করে পেজের মতো করে গ্রুপ খোলা যায় এবং এতে সমগোত্রীয় সবাই সহজভাবে দলীয় যোগাযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।

ফেসবুকের রয়েছে ভার্চুয়াল মুদ্রা যার নাম লিব্রা; Image Courtesy: thumbor.forbes.com

ফেসবুক লেগেসি: ফেসবুকে নিজের মৃত্যুর পর বা নিজের আইডি সমস্যায় পরলে অন্য একজন নির্বাচিত ব্যবহারকারী আইডি রক্ষণাবেক্ষণ বা আইডি ফিরিয়ে আনার সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এই ফিচারটির নামই Facebook Legecy Contacs।

পোক: ফেসবুকে খুবই চমকপ্রদ একটি ফিচার পোক। এই ফিচারের মাধ্যমে এক ব্যবহারকারী অন্য ব্যবহারকারীকে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে অবগত করতে পারে।

ভেরিফাইড পেজ এবং অ্যাকাউন্ট: ফেসবুকে জনপ্রিয় ও সর্বজনস্বীকৃতব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পেজ ও অ্যাকাউন্টকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভেরিফাইড বা সত্যায়িত করা হয় ও ভেরিফাইড করার ফলে তা এককভাবে সনাক্ত করা যায়।

সি ফাস্ট: ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজের পছন্দের আইডি বা পেজে ‘সি ফাস্ট’ দিয়ে রাখতে পারে। এতে করে সবার আগে সি ফাস্ট দেয়া আইডি বা পেজের তথ্য নিজের নিউজ ফিডে দেখতে পারে যা বহু পোষ্টের ভিড়ে নিজের রুচি অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত পোস্ট সহজে খুঁজে পাওয়া যায়।

কাস্টম ফ্রেন্ডলিস্ট: ব্যাক্তিগত ছবি শুধু ঘনিষ্ঠজনদের সাথে শেয়ার করার জন্য ফেসবুকে কাস্টম ফ্রেন্ডলিস্ট ফিচারটি ব্যবহার করা যায়।

আনফলো: ফেসবুকে কারও পোস্ট দেখতে না চাইলে তাকে ফ্রেন্ড রেখেও আনফলো ফিচার ব্যবহার করে আনফলো করা যায়। এতে তার পরবর্তী কোনো পোস্ট আর নিউজফিডে আসে না।

লাইভ ম্যাপ: ফেসবুকে লাইভ ম্যাপ ফিচারটির মাধ্যমে ব্যবহারকারী সরাসরি বিশ্বে যেকোনো জায়গার লাইভ কার্যক্রমের ম্যাপ দেখতে পারে।

ফেসবুকের রয়েছে লাইভ ম্যাপ ফিচার; Image Courtesy: manycam.com

ফেসবুকের কার্যাবলী ও ইতিবাচক প্রভাব

পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এক উদ্ভাবন ফেসবুক। বিশ্বায়নের এ যুগে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের খুব কার্যকরী একটি প্লাটফর্ম ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিতে স্বল্পব্যায়ে নিজের মত প্রকাশ, ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে আলাপ আলোচনা করা যায়। এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও বিপণনের কাজও সেরে নেওয়া যায়। ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবহারকারী নিজের জানার পরিধি বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়াও ফেসবুকের মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ সংবাদ জানা, নিজের সম্পর্কে অন্যর কাছে সহজে প্রকাশ, পড়ালেখার সহযোগী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার, তথ্য আদান প্রদান, নাগরিক সাংবাদিকতা, অনলাইন ই-কমার্সের ব্যবসায়, একাকীত্ব দূর, সামাজিক যোগাযোগ ও কার্যক্রম বৃদ্ধি, নতুন বন্ধু তৈরি, পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া, মতবিনিময় বা পরামর্শ দেয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের সুযোগ, সমাজসেবার সুযোগ ইত্যাদি করা যায়।

ফেসবুকের বহু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে; Image Courtesy: stream.org

ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাব

ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে চরম আসক্তি তৈরি ও সময় নষ্ট, পড়াশোনার ক্ষতি, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও অশান্তি, গুজব ও উদ্দেশ্যপূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর সুযোগ, ছবি ও সেলফি আসক্তি বৃদ্ধি, লাইক-কমেন্টের প্রত্যাশায় বাড়াবাড়ি, তথ্য চুরি, প্রতারণার সুযোগ বৃদ্ধি, নারীদের হয়রানির সুযোগ বৃদ্ধি, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ সহায়ক, রাজনৈতিক উগ্রবাদ ছড়ানোর মাধ্যম, একাকিত্ব বোধ বাড়া, জীবন সম্পর্কে হতাশা তৈরি, ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই অন্যের হাতে চলে যাওয়া, রাত জাগা সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রধান। এককথায় ফেসবুক অনেক তরুনের উৎপাদনশীলতা, কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতা কেড়ে নিচ্ছে। এছাড়াও ফেসবুকের প্রতি তীব্র আসক্তি নানা শারীরিক সমস্যা যেমন: পিঠব্যথা, মাথাব্যথা, মেরুদণ্ডের সমস্যা, চোখের কম দেখা, শরীরের ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ও ঘুমের ব্যাঘাত হয়। ২০১৭ সালে ফেসবুকের একজন কর্মকর্তা চামাথ পালিয়াপিতিয়া ফেসবুক প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “আমরা এমন মাধ্যম তৈরি করেছি যা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের গঠনকে ধ্বংস করে ফেলছে।” পালিয়াপিতিয়ার মতে, “ফেসবুক হচ্ছে ডোপামিন পরিবাহক একধরনের স্বল্পমেয়াদী ফিডব্যাক লুপ।”

ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি ফেসবুকের বহু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে; Image Courtesy: makeuseofimages.com

ফেসবুক নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক

ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ এবং ভার্চুয়াল বিনোদনে প্রচুর ভূমিকা রাখলেও এ পর্যন্ত অনেকবারই প্রতিষ্ঠানটি সমালোচনা এবং বিতর্কের স্বীকার হয়েছে। বিশেষ করে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে ফেসবুক বারবার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সম্প্রতি কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি ওয়েবসাইটের কাছে ফেসবুকের তথ্য বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভারত, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে মানুষের ব্যাক্তিগত তথ্য বিক্রির কাজ করেছে বলে অভিযোগ আছে। তবে ফেসবুকের বিরুদ্ধে বর্তমানে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ফেসবুকের থেকে ব্যাক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে ব্রেক্সিটের পক্ষে, মার্কিন নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে সিনেটর টেড ক্রুজের পক্ষে এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। ফেসবুক থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহকৃত এই তথ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সাথে সরাসরি সংযোগের প্রমাণ মিলেছে এবং মার্ক জুকারবার্গ বিষয়টি স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে ফেইসবুকের ভুয়া খবর জনমতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যোগাযোগ এবং প্রতিহিংসা ছড়াতে ফেসবুকের সাহায্য নিয়েছে। যেহেতু ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে খুব বেশি স্পেসিফিক তথ্যের প্রয়োজন পড়ে না তাই কোনো ব্যাক্তি সহজেই ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

ফেসবুক নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক; Image Courtesy: inquirer.com

সিএনএন এর এক তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বে ৮৩ মিলিয়ন ভুয়া ফেসবুক আইডি রয়েছে। এই ভুয়া আইডি ব্যবহার করে বা ভুয়া আইডিতে বিভিন্ন ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে অনেক অবমাননাকর বা দুর্নীতিমূলত বা হুমকিমূলক কাজ করা হচ্ছে। ভিন্নধারার অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যসেঞ্জ বলেছেন, “ফেসবুক মানুষের ইতিহাসে গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত সবচেয়ে ঘৃণাব্যঞ্জক হাতিয়ার।” এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া খবর এবং বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য বিভিন্ন দেশ নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ, ইরান, মিশর, চীন, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ভারত, ইসরায়েল, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মরক্কো, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে ফেসবুক সাময়িক সময়ের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। চীন নিরাপত্তা প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফেসবুক নিষিদ্ধ করেছে। ২০১৮ সালে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ফেসবুক পোস্টের প্রাইভেসি সেটিংস ‘ফ্রেন্ডস’ থেকে ‘পাবলিক’ হয়ে যায় যার ফলে বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারীর প্রাইভেসি হুমকির মুখে পরে। আমরা কী ধরনের স্ট্যাটাস, ছবি বা ভিডিওতে লাইক দেই, কোন কোন শব্দ আমাদেরকে বেশি আকর্ষণ করে, কোন ধরনের সংবাদ পড়ি, কোন ধরনের লিংকে ক্লিক করি, এসব তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করাটাই ফেসবুকের মূল ব্যবসা বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ভারতে লোকসভা ভোটে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কংগ্রেসের প্রায় ৭০০ পেজ সরিয়ে নিয়েছিল ফেসবুক। ফেসবুক নিজেকে একটি সেবা হিসেবে দাবী করলেও এটি মূলত একটি ব্যবসা এবং এটি শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস। ফেসবুকের আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন তাই হয়তো ভুয়া বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে ফেসবুক উদাসীন।

ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যাক্তিগত তথ্য ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে; Image Courtesy: thechurchillobserver.com

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফেসবুকের প্রভাব

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে ফেসবুকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একটি সংগঠন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ফেসবুকের মাধ্যমেই সংগঠিত হয়েছিল এবং সেই সংগঠনের আন্দোলনের ফলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনা ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তরুণ ফেসবুক এক্টিভিস্টের তৎপরতার দোষীদের বিচারও হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি দাসের লাঞ্ছনার ঘটনাও প্রথম জানা যায় ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ভিডিওর মাধ্যমে এবং ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার দোষীর বিরুদ্ধে অতিসত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফেসবুকে বুয়েট ছাত্র আবরার বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ায় তাকে তার সহপাঠীরা হত্যা করে এবং ফেসবুকে এ হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে। ২০১০-১১ সাল জুড়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের পেছনে ফেসবুকের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। আইএএনএসের তথ্যমতে নতুন ক্রেতা বা গ্রাহক খোঁজার পাশাপাশি কর্মী নিয়োগ ও গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগে প্রতি মাসে ১৪ কোটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফেসবুকের অ্যাপ ব্যবহার করছে।

ফেসবুকের মাধ্যমেই সংগঠিত হয়েছিল বহুল আলোচিত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’; Image Courtesy: jugantor.com

২০১৩ সালে বাংলাদেশে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, বৌদ্ধদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নভেম্বর ২০১৭ সালে রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় হামলা ও হতাহতের ঘটনায় ছিল দুর্বৃত্ত কর্তৃক ফেসবুকের অপব্যবহার। ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করায় গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর ভোলায় ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন নিহত হয়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার নেপথ্যে ছিল একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস যেখানে প্রধান মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুককে। নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে হামলাকারী বন্ধুকধারী তার হামলার ভিডিও ফেসবুকে লাইভ প্রচার করেছিলো। বর্তমানে সমাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ফেসবুকের অপব্যবহার এতো নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে যে ফেসবুকের উপর নিয়ন্ত্রন আনতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশে সরকার ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর থেকে দেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে দুটি পৃথক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে পরবর্তী ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ রাখার পরে তা খুলে দেয়। এছাড়াও বর্তমানে ফেসবুকের উপর ট্যাক্স আরোপ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

আমেরিকা ও বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ফেসবুক; Image Courtesy: wsj.net

ফেসবুক ব্যবহারে সতর্কতা
ফেসবুকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে এর ইতিবাচক ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলা উচিত। এগুলো হচ্ছে:

ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সিকিউরিটি বৃদ্ধি করা, অনলাইনের অশালীন ছবি ও তথ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা, বিনোদনের নামে ফেসবুকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে না পরা, কিছুদিন পরপর ফেসবুকের সিকিউরিটি সেটিং চেক করা, ফেসবুক প্রাইভেসি বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা, ফেসবুকের অভ্যন্তরে গেম, কুইজ না খেলা, সীমিত সময় ফেসবুক ব্যবহার করা, ফেসবুকে কেউ কোনো নিউজ শেয়ার দিলেই সেটাতে জলদি ক্লিক না করা বা বিশ্বাস না করা বা শেয়ার না করা, শুধু প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের দেওয়া লিংকে ক্লিক করার অভ্যাস তৈরি করা, ভেরিফাইড পেজের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া, ফেসবুক বাদে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট থেকে সংবাদ পড়া, ফেসবুকে ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বল করা, অপরিচিত মানুষের সাথে ফেসবুকে অপ্রয়োজনে যোগাযোগ না করা ইত্যাদি।

ফেসবুক ব্যবহারে বেশ কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত; Image Courtesy: greenarea.me

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সারা পৃথিবীতে ফেসবুক সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ফেসবুকের ব্যবহারের সকল নেতিবাচকতাকে পেছনে ফেলে ফেসবুকের নানা ইতিবাচক কার্যক্রম ও প্রভাবও সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। তাই সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীর উচিত ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ম-নীতি যথাযথভাবে মেনে চলা ও শুধু ফেসবুকের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহন করে নিজেকে বিকশিত করে তোলা। অন্যদিকে ফেসবুকের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভুলতা বৃদ্ধি করা। তাহলেই ফেসবুক হবে আরও জনমুখী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের অবস্থান থাকবে শীর্ষে।

Feature Image Courtesy: independent.co.uk

Share to spread the knowledge

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *