Rafij Khan
Feature Writer And Sub Editor
News Views Media
রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন হয়। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, এমনকি জনগনের কাছেও জাতীয় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগন দেশ পরিচালনার প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ পায় রাষ্ট্র পরিচালনার ম্যান্ডেট, আবার কেউ পরাজিত হয়ে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য জনসমর্থন আদায় করার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচন দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সংযোজন। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে সর্বশেষ সংযোজন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পটভূমি
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনেকটা সাদামাটাভাবেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে তিন মেয়াদে সরকার প্রধান থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ চার দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে। এছাড়া ছোটবড় সমমনা আরও বেশ কয়েকটি দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। যার ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৪ আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য দল জাতীয় পার্টি পায় ৩৪ আসন। দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ১৫৪ টি আসনে প্রার্থী সংকটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। সুতরাং দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমঝোতা না হওয়া এবং বিএনপির নির্বাচন বর্জন করায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপি একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন প্রস্তুতি নিলে সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগকে ছাড়াই দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগ বিহীন সেই নির্বাচনে খুব সহজেই বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। উক্ত নির্বাচনে দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অনেক বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করায় সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে বিএনপি সরকার সংসদের মাত্র ১২ কার্যদিবসের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও এবং এই নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও দেশে কোন মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। তাই ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু পূর্ববর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণমূলক ছিল না তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল রাজনৈতিক ও জাতীয় পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচনী নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঠিক কোন পন্থায় অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিতর্ক খুব পুরনো। তত্ত্বাবধায়ক না দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সবসময় দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ছিল বিপরীতধর্মী অবস্থান। ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন সরকারে ছিল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকারে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল বিএনপি। ২০১৮ সালে দেশ যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখনও দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকে। অন্যদিকে বিএনপি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথা বলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল ছিল। কিন্তু বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা কাজ করছিল। তাই যেকোনো উপায়েই নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির কেন্দ্র ও তৃণমূল থেকে একটা চাপ ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজ দাবি থেকে সরে এসে বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
ঐক্যফ্রন্ট গঠন ও আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং গত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ছিল। এছাড়াও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাগারে এবং দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় দলটি নেতৃত্ব সংকটে ভুগছিল। তাই তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত তৃতীয় কোন বিখ্যাত ব্যাক্তিকে সাথে নিয়ে জোট গঠন করে নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে চমক আনতে চেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়। এই জোটের শরীক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ অন্যতম।
ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নির্বাচনকালীন সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনকালীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও সকল রাজনৈতিক মামলা স্থগিতসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের সাথে সংকট নিরসনে দফায় দফায় আলোচনা ও গোল টেবিল বৈঠক করে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরে। কিন্তু এদের মধ্যে বেশীরভাগ আলোচনাই ব্যর্থ হয় এবং ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো শুধু দাবি হিসেবেই রয়ে যায়।
তফসিল ঘোষণা
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ও নানা দাবি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টসহ দেশের বিরোধী দলগুলোর সাথে ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের ফলপ্রসু আলোচনা না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্তমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়। কেননা সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। তাই ৯ নভেম্বর, ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। উক্ত তফসিলে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ১৯ নভেম্বর, বাছাইয়ের শেষ তারিখ ২২ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৯ নভেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ৩০ নভেম্বর ও নির্বাচনের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়। একইসাথে তফসিল ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে বলেও আশা প্রকাশ করা হয়।
দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ, যাচাই বাছাই ও সংঘর্ষ
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরেই প্রতিটি রাজনৈতিক দলে প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নের জন্য লড়াই শুরু করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের টিকিট পাওয়ার জন্য প্রার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পরে। টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিটি আসন থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা দেখায়। মোট ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগ বিক্রি করে সর্বমোট ৪ হাজার ২৩ টি মনোনয়ন ফর্ম।
অন্যদিকে টানা ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপিতে রেকর্ড সংখ্যক চার হাজারের বেশি মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হয়। অতঃপর মহাজোটের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ায় ২৩০ টি আসন ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ নিজেদের জন্য রেখে বাকি ৭০ টি আসন জোটের শরিকদের জন্য ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। অন্যদিকে বিএনপি নিজেদের জন্য ২০৬ আসন রেখে বাকি ৯৪ টি আসন ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরীক দলগুলোর জন্য ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। যদিও কৌশলগত কারণে পরবর্তীতে ৩০০ আসনে ৮০০ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় দলটি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে পরবর্তীতে যখন চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয় তখন মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা বাধ ভাঙ্গা উল্লাস করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীর বহু সমর্থক বিক্ষোভ; এমনকি দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটায়।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়ন যাচাই-বাছাই, বাতিল ও চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা
দলীয় মনোনয়ন জমা ও যাচাই বাছাইয়ের পর মহাজোট, ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোটসহ সকল প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে থাকে। সারাদেশ থেকে সর্বমোট ৩০৯৫ জন প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন জমা দেয়। এরপর শুরু হয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়ন যাচাই-বাছাই, বাতিল ও চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঋণখেলাপি, মনোনয়নপত্র অসম্পূর্ণসহ নানা কারণে শুরু হয় প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের হিড়িক। নির্বাচন কমিশন যাচাই-বাছাই করে ২২৭৯ জন প্রার্থীর প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে বিএনপির ১৪১ প্রার্থী, ইসলামী দলগুলোর ৪৯ প্রার্থীসহ সর্বমোট ৭৮৬ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়। এমনকি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কাদের সিদ্দিকী, গোলাম মাওলা রনি, রুহুল আমিন হাওলাদার, আমান উল্লাহ আমান, এম মোর্শেদ খান, আফরোজা আব্বাস, রেজা কিবরিয়া সহ বহু প্রভাবশালী নেতার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। কিন্ত অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী লীগের মাত্র অল্প কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়। মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে ৮২ জন প্রার্থী আপিল করে। আপিলে অল্প কিছু প্রার্থী মনোনয়ন ফিরে পেলেও বেশীরভাগ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলই থাকে। এর মধ্য বিএনপি, আওয়ামী লীগ, মহাজোট, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের একাধিক প্রার্থীদের মধ্যে চলতে থাকে নানা হিসাব নিকাশ। তারপর ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয় এবং ১০ ডিসেম্বর দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১৮৬১ জন প্রার্থী নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেয়। এরমধ্যে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ছিল ১ হাজার ৭৩৩ জন আর স্বতন্ত্র হিসেবে লড়েছে ১২৮ জন।
খালেদা জিয়ার মনোনয়ন বাতিল
বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলে থাকা অবস্থায়ই ফেনী ১, বগুড়া ৬ ও ৭ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে। কিন্তু খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে। দলের চেয়ারপার্সনের মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্তে বিএনপির মধ্যে হতাশার তৈরি হয়। মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে আপিল করা হয়। আপিলে দ্বিধাবিভক্ত রায়ে খালেদা জিয়ার মনোনয়ন চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়। এর প্রতিবাদে বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং সরকারী নির্দেশে খালেদা জিয়ার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়। কিন্তু অন্য কোন উপায় না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বিএনপির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিয়া পরিবারের কাউকে ছাড়া বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়।
নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটের পরিবেশ
সকল প্রার্থীরা দলীয় চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ শুরু করে। কিন্তু জনসংযোগের দিক দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের তুলনায় মহাজোটের প্রার্থীরা ছিল প্রচুর এগিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ক্ষমতাশীল দলের প্রতিনিধি হওয়ায় অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজ নিজ এলাকায় গাড়িবহর, মাইক ইত্যাদি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে তাদের দুই মেয়াদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় করা উন্নয়নকে। অন্যদিকে হামলা-মামলা-গ্রেফতারের ভয়ে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের ভোটের মাঠে খুব বেশি দেখা যায় নি। অনেকটা মাঠের বাইরে থেকে গোপনে গোপনে প্রচার চালিয়েছে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা তাদের প্রচারনার কৌশল হিসেবে দেশে ‘গনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার’ কথা বলেছে।
সারাদেশে নৌকা প্রতীকের পোস্টারে যখন প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকা ছেয়ে গিয়েছিল তখন প্রায় প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর পোস্টার ছিল হাতে গোনা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছিল বেশ সরব। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থীরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও নির্বাচনী প্রচারণায় পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে নি। একদিকে মহাজোটের প্রার্থীরা ভোটের পুরো সময় নির্বাচনের পরিবেশ সম্পূর্ণ ঠিক আছে বলে দাবী করে আসছিল। অন্যদিকে নির্বাচনী মাঠে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নেই বলে বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল বিরোধীরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার ঘোষণা
প্রতিটি নির্বাচনের আগেই প্রার্থী ও দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল আলাদা আলাদা ভাবে ইশতেহার ঘোষণা করে। একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে ২১ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ইশতেহারে তারুণ্য এবং গ্রামের উন্নয়নকে আলাদাভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। এছাড়াও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশুকল্যাণ, পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল, মেগা প্রজেক্টগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, দারিদ্র্য নির্মূল, সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি, সকলের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা, সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন, জনবান্ধব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্লু ইকোনোমি ও সমুদ্র সম্পদ উন্নয়ন, নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী এবং অটিজম কল্যাণ, টেকসই উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯ দফা অঙ্গীকার করেছিল। এর মধ্যে ইশতেহারে অর্থনীতি, মুক্তিযোদ্ধা ও যুব, নারী ও শিশু, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান, জ্বালানি, তথ্য ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, বৈদেশিক ও প্রবাসীকল্যাণ, কৃষি ও শিল্প, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, প্রতিরক্ষা ও পুলিশ, আবাসন, পেনশন ফান্ড ও রেশনিং ফান্ড প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ, পররাষ্ট্র এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এছাড়াও ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, গণতন্ত্রের অনুশীলন, রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ় করা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইন’৭৪ বাতিল, বেকার ভাতা প্রদানসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এছাড়াও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি, যুক্তফ্রন্ট, বিকল্পধারা ও ইসলামী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়।
পুলিশি গ্রেফতার, মাঠে প্রভাব বিস্তার, হামলা-প্রতিহামলা
বাংলাদেশের সকল জাতীয় নির্বাচনেই ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক ও পেশী শক্তির সর্বাধিক প্রয়োগের চেষ্টা করে। তাই জাতীয় নির্বাচনে পুলিশি গ্রেফতার, মাঠে প্রভাব বিস্তার, হামলা-প্রতিহামলা ঘটেই থাকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ব্যাতিক্রম নয়। দীর্ঘ ১০ বছর পর প্রায় সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের আগ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। নৌকা ও ধানের শীষ প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের মাঠে হানাহানি ও সংঘাতের সম্ভবনা ছিল খুব বেশি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এমনকি কোন কোন এলাকায় আওয়ামীলীগের নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যকার সংঘর্ষেরও সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বেশীরভাগ আসনে বিএনপির প্রার্থীরা মাঠে প্রভাব বিস্তার তো দুরের কথা বরং আত্মগোপনে থেকে নিজেদের প্রচারণা চালিয়ে যেতে থাকে। সারাদেশে বিএনপির হাজার হাজার নেতা কর্মী গ্রেফতার হয়েছে বলেও দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। ঐক্যফ্রন্ট কর্মীদের গ্রেপ্তার, হামলা, মামলা নিয়ে কয়েকবার নির্বাচন কমিশনেও যায় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ডঃ কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা, বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে হামলা, রামগঞ্জে বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর ইত্যাদি ছিল সংবাদপত্রের প্রধান প্রধান শিরোনাম।
সেনাবাহিনী মোতায়েন
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠে সেনাবাহিনী থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে ছিল নানা জল্পনা কল্পনা। তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই ঐক্যফ্রন্ট সহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকৃত প্রায় সব কয়টি বিরোধী দল নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রথম দিকে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমন কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর বারবার দাবির মুখে নির্বাচন কমিশন একবারে শেষ দিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৬ দিন আগে দেশের ২৯৯ টি আসনে প্রায় ৫০ হাজারের মত সেনা সদস্য মোতায়েন করে নির্বাচন কমিশন। দেশের ৬ টি আসনে ইভিএমের দায়িত্বও পালন করে সেনা সদস্যরা। নির্বাচনকালীন সময়ে সেনা সদস্যরা সারাদেশে টহল দিলেও ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতি ছিল না। এমনকি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্বাহী আদেশ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেনি সেনাবাহিনী। তবে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে জনগনের মধ্যে এক প্রকার স্বস্তি কাজ করেছিলো। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই দিন পর তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
ইভিএম নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা
দেশে Electronic Voting Machine বা EVM এর ব্যবহার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা উপনির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই প্রথম। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ বরাবরই ইতিবাচক অবস্থান প্রদর্শন করেছে। অন্যদিকে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রথম থেকেই বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো এর বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর চরম বিরোধিতা থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অল্প কিছু আসনে নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর দৈব চয়নের মাধ্যমে ঢাকা ৬, ঢাকা ১৩, রংপুর ৩, খুলনা ২, সাতক্ষীরা ২, চট্টগ্রাম ৯ সহ মোট ৬ টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী উক্ত আসনগুলোতে ২৭ ডিসেম্বর মক ভোটের আয়োজন করা হয় এবং ৩০ ডিসেম্বরের উক্ত আসনগুলোতে ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটের দিন
নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটের দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নির্বাচনের আগে যাই হোক না কেন নির্বাচনের দিনই ঠিক হয় কে হবে বিজয়ী। তফসিল ঘোষণার সময় নির্বাচনের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ঠিক করা হলেও পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন পুনঃতফসিল ঘোষণা করে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করে। অবশেষে নানা শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও ভয়ের মধ্যে দিয়েই ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের দিন সারাদেশে সব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ৫১টি, ভোট কক্ষ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৬৯১টি, মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৮২৩ জন। এছাড়াও ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার, ৫৮২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার, বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৬ লাখ ৮ হাজার নিরাপত্তারক্ষী, ১ হাজার ৩২৮ জন নির্বাহী হাকিম ও ৬৪০ জন বিচারিক হাকিম, ৮১টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন প্রতিনিধি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের ৯৯ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচনের দায়িত্তে ছিলেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর থেকে প্রচারণা পর্যন্ত ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আসছিল। ঠিক তেমনিভাবে নির্বাচনের দিনও সার্বিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভোটের পরিবেশ সন্তোষজনক বলা হয়। এমনকি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে বলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়। অন্যদিকে বিএনপি ভোটের আগের রাত থেকেই নির্বাচনে কারচুপির নানা অভিযোগ তুলতে থাকে। এমনকি ভোটের দিন সকালে বিএনপির পক্ষ থেকে পুলিশ ও ইসির পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, বিরোধী দলের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, দলীয় নেতা কর্মীদের গ্রেফতার, ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে লাইন জ্যামিংসহ নানা অভিযোগ তোলা হয়। এছাড়া নির্বাচনের দিন দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে দুই দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ঠিক এমনভাবেই অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনের দিন অতিবাহিত হয়।
ঐক্যফ্রন্ট ও বিরোধীদের ভোট বর্জন
সকালে ভোট ভোট শুরুর হওয়ার পর থেকেই বহু এলাকার বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের শরীক প্রার্থীরা নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিতে থাকে। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে দুপুরের মধ্যেই প্রায় ১০০টির আসনের বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রার্থীদের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তকে তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেন। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের বহু প্রার্থী নিজ নিজ জায়গা থেকে নির্বাচন বয়কট করলেও বিএনপি দলগতভাবে এবং ঐক্যফ্রন্ট জোটগতভাবে নির্বাচনের ভোটগ্রহনের শেষ পর্যন্ত ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ আসনে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ছিলেন না।
নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হবার পর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট কৌশলগত কারণে অল্প কিছু আসনের ফলাফল আসার জন্য অপেক্ষা করে। তবে জামায়াত ইসলামী দুপুর ২ টায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ায়। সন্ধ্যায় যখন একের পর এক আওয়ামী প্রার্থীদের ভোটে এগিয়ে থাকার খবর আসতে থাকে তখন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেয়। ভোটের দিন সন্ধ্যায় নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে। একইসাথে অনতিবিলম্বে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবী জানায়।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ডঃ কামাল হোসেন বলেন, “দেশের সব জায়গা থেকে ভোট ডাকাতির খবর এসেছে। প্রহসনের এই নির্বাচন বাতিল করা হোক।” অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, “অনেকে বলে থাকেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হলো যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আমরা পুরো নির্বাচন প্রত্যাখান করেছি।” কিন্তু আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে উক্ত নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে দাবি করা হয়।
নির্বাচনের অবিশ্বাস্য ফলাফল
নির্বাচনের ফলাফল যখন আসতে শুরু করে তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকবে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে আওয়ামী লীগ যে এতটা আশ্চর্যজনক ফলাফল করবে এবং দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি যে এতটা হতাশাব্যাঞ্জক ফলাফল করবে সেটা কেউ বুঝতে পারে নি। নির্বাচন কমিশনের থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী দেখা যায়, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা সর্বমোট ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন। এরমধ্যে আওয়ামী নিজে একাই ২৫৯ টি, জাতীয় পার্টি ২২ টি, বিএনপি ৬ টি, গণফোরাম ২ টি, সমাজতান্ত্রিক দল ৩ টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২ টি, বিকল্পধারা ২ টি, তরিকত ফেডারেশন ১ টি ও স্বতন্ত্র ৪ টি আসন লাভ করে। সর্বমোট ২২ টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা
দেশের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সার্বভৌম ক্ষমতা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। এমনকি অনেকে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একদিকে যেমন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে নিরপেক্ষ বলে প্রচার করেছে।
অন্যদিকে বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও বামধারার রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের পুরো সময় জুড়েই নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট ও সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ তুলেছে। সুশীল সমাজের একাংশের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে না পারা, বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের হামলা-মামলা-গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ইসির নির্বিকার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। একইসাথে তারা নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা, ভোটদানে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগের ক্ষেত্রে ইসির ভূমিকার সমালোচনা করেন।
নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের জয়ী প্রার্থীদের সংসদে যাওয়া না যাওয়া
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৮ টি আসন পেয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। বিএনপির মতো এত বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে থাকা ঐক্যফ্রন্টের কাছে এই ফলাফল হতাশার সৃষ্টি করে। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের শোচনীয় ফলাফলের কারণ হিসেবে তারা নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে দাবি করে। একইসাথে যেহেতু তারা এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই জোটের পক্ষ থেকে জয়ী প্রার্থীদের শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শপথ না নেয়ায় সাংবিধানিকভাবে ঐক্যফ্রন্টের জয়ী প্রার্থীরা সংসদে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিলে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক নানা সমীকরণে পরবর্তীতে বিএনপি, গণফোরামসহ ঐক্যফ্রন্টের সকল জয়ী প্রার্থী (মির্জা ফখরুল বাদে) শপথ নিয়ে সংসদে যায়। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
জয়ী প্রার্থীদের শপথ গ্রহণ ও মন্ত্রীসভা গঠন
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণার পর ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ সালে ২৮৯ প্রার্থী জাতীয় সংসদ ভবনে শপথ গ্রহণ করে। এই শপথ গ্রহনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় একাদশ জাতীয় সংসদের। বিএনপির ৫ জন, গণফোরামের ২ জন, এরশাদ ও সৈয়দ আশরাফ শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকে। সংসদ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার নাম চূড়ান্ত হয়।
শপথ গ্রহনের পরেই শুরু হয় মন্ত্রীসভা গঠনের কাজ। একাদশ জাতীয় সংসদের মন্ত্রীসভায় যে চমক থাকবে সেটা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছিলো। মন্ত্রীসভার সদস্যদের নাম ঘোষণার পর সত্যিই বোঝা যাচ্ছিল যে এবারের মন্ত্রীসভায় চমক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৪৬ সদস্যর মন্ত্রীসভায় ২৪ জন পূর্ণমন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিন জন উপমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে নারী মন্ত্রী ৪ জন এবং প্রধাণমন্ত্রীর অধীনে রাখা হয় ৬ টি মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে গত মন্ত্রীসভার ৩৬ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বাদ পরেন। একইসাথে নতুন মন্ত্রীসভার পূর্ণমন্ত্রীর মধ্যে ৯ জন, প্রতিমন্ত্রীর মধ্য ১৬ জন এবং উপমন্ত্রীর মধ্য ৩ জনই ছিল নতুন মুখ। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নতুন পুরাতন মিলিয়ে অনেকটা চমকের মন্ত্রীসভাই গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক থেকেই যায়। জয়ী প্রার্থী বা দলেরা সবসময় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে দাবি করে। অন্যদিকে পরাজিত প্রার্থী বা দলেরা নির্বাচনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করে। তবে সে যাই হোক, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটুকু অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে, সেটা বিচার করার মূল দায়িত্ব দেশের জনগণের। কেননা জনগনই হচ্ছে ক্ষমতার মূল উৎস।
Feature Image: jagonews24.com