Rafij Khan
Feature Writer And Sub Editor
News Views Media
ভারতীয় উপমহদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। এটি ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বৃহত্তম ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষ। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ১৯০৬ সালে প্রথম মুসলিম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মুসলিম লীগ। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতবর্ষ তথা বাংলায় কতটুকু গণমানুষের দল ছিল? উত্তর হচ্ছে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ব্রিটিশ শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে গণমানুষের দল হয়ে উঠতে পারে নি। কেননা ভারতবর্ষের কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের প্রাণের দাবিগুলো নিয়ে কখনই এই রাজনৈতিক দল দুটি তেমন মাথা ঘামায় নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভারতবর্ষের কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত মানুষের মৌলিক দাবিগুলো থেকে তারা ছিল যোজন যোজন দূরে। মুসলিম লীগ তো অনেকটা অভিজাত ও জমিদার শ্রেণীর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ভারতবর্ষের গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম রাজনৈতিক দল কোনটি?
ভারতবর্ষে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম রাজনৈতিক দল কোনটি সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু বাংলার গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম রাজনৈতিক দল যে কৃষক প্রজা পার্টি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টিই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের এলিটিজমের বাইরে গিয়ে সর্বপ্রথম প্রকৃত অর্থেই বাংলার গণমানুষের দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলার বঞ্চিত কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের অধিকারের কথা তুলে এনেছিল রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে।
কৃষক প্রজা আন্দোলনের পটভূমি
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় ২০০ বছরে কৃষকের দুরবস্থার কথা সকলেরই জানা। ১৭৯৩ সালে যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় তখন সাধারণ কৃষক তাদের ফসলি জমি হারায়। ফসলি জমির নতুন মালিক হয় জমিদার সম্প্রদায়। শুরু হয় জমিদার ও কৃষক-প্রজা সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক। জমিদার সম্প্রদায় কৃষক-প্রজাদের থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে শুরু করে। কৃষক অতিরিক্ত খাজনা না দিতে পারলে জোরপূর্বক তাদের ভিটেমাটি দখল ও নির্যাতন করা শুরু হয়। এতে কৃষকেরা হয়ে পরে সর্বস্বান্ত। ১৮৫৯ সালে বাংলার প্রজাস্বত্ব আইন কায়েম করা হলেও এতে খাজনার হার স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করে দেয়া ছিল না। এতে করে প্রজারা জমিতে তাদের দখলি স্বত্ব কায়েম করতে পারে নি। ফলে জমিদারদের অতিরিক্ত খাজনা ও করের ভারে বাংলার প্রজারা দিশেহারা হয়ে যায়। অতিরিক্ত খাজনার ভার মেটাতে কৃষকেরা মহাজনদের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয়া শুরু করে। পরবর্তীতে যখন এই টাকা পরিশোধ করতে না পারে, তখন জমিদার ও মহাজনের সম্মিলিত নির্যাতনের স্বীকার হয় কৃষকেরা। ১৮৮৫ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’ পাস করা হয়। এতে চাষিরা তাদের স্থায়ী স্বত্ব লাভ করলেও অনেক কৃষক এই আওতার বাইরে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে এই আইনে মধ্যবিত্ত জোতদার সম্প্রদায়ের মানুষেরা লাভবান হয় এবং অধিকাংশ কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নামের দুটি বড় রাজনৈতিক দল থাকলেও তারা কখনোই কৃষক শ্রেণীর এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন নি।
১৯০৬ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান তখন সে কৃষকের দুরবস্থা সরোজমিনে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। কৃষকের এই দুরবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষকের ভাগ্য ফিরিয়ে আনার সংকল্প করেন। ফজলুল হক সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯১৩ সালে প্রাদেশিক বাংলা মুসলিম লীগের সম্পাদক নিযুক্ত হন। এছাড়াও সে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে বিংশ শতাব্দীতে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ১৯১৪ সালে সংগঠিতভাবে শুরু হয় প্রজা আন্দোলন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রজা আন্দোলনকে নেতৃত্বদানের জন্য এগিয়ে আসেন। ১৯১৪ সালে জামালপুরের, ১৯২৪ সালে ঢাকার, ১৯২৬ সালে মানিকগঞ্জের প্রজা সম্মেলনে ফজলুল হক নেতৃত্ব দান করেন। ১৯১৭ সালে কৃষক সমিতি, ১৯২০ সালে বেঙ্গল জোতদার ও রায়ত এসোসিয়েশন গড়ে তুলে প্রজাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও ফজলুল হক নেতৃত্ব দান করেন। ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইন পাশের মাধ্যমে প্রজারা কিছু অধিকার ফিরে পায়। তবে ১৯২৯ সালের আগে বাংলায় কৃষক প্রজা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী কোন রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না।
প্রজা পার্টি, প্রজা সমিতি ও কৃষক প্রজা পার্টি গঠন
প্রজা পার্টি ও প্রজা সমিতি থেকেই মূলত কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হয়। ১৯২৯ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রজা পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য সম্মিলিতভাবে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠিত হয় এবং নির্বাচনের পর বঙ্গীয় আইন পরিষদের ১৮ জন মুসলিম সদস্য নিয়ে ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রজা পার্টি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের মধ্যে আবদুর হাকিম, তমিজউদ্দিন খান, বাহাদুর আজিজুল হক, শাহ আবদুল হামিদ, ফজলুল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন উল্লেখযোগ্য। আর নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির নেতাদের মধ্যে বিচারপতি স্যার আবদুর হাকিম, মওলানা আকরাম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শামসুদ্দীন আহমেদ, তমিজুউদ্দীন খান, মৌলভী আবদুল করিম অন্যতম। প্রজা পার্টি প্রথম থেকেই কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার নীতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে প্রজা সমিতি গ্রামে গ্রামে কৃষকের অধিকারের পক্ষে কাজ করতে থাকে এবং জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সোচ্চার করতে থাকে। এর ফলে ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে গ্রামে গ্রামে কৃষক ও প্রজা সমিতি গঠিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন জেলার কৃষক সমিতি প্রজা সমিতির সাথে একাত্মতা পোষণ করতে থাকে। ১৯৩৫ সালে ফজলুল হক প্রজা সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন। সভাপতি নিযুক্ত হয়ে তিনি সকল প্রজা ও কৃষক সমিতি গুলোকে একত্রিত করে কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন। ফজলুল হক এর সভাপতি ও শামসুদ্দিন আহমদ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হওয়ার পর তারা লোকাল বোর্ড ও জেলা বোর্ডে প্রতিযোগিতা করে আশাতীত সাফল্য পায়। অতঃপর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেটিকে সামনে রেখে দলটি সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পূর্বে বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির অবস্থান
১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন জারির পর সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির আত্মপ্রকাশের অল্প দিন হলেও দলটি ছিল সাংগঠনিকভাবে তুলনামূলক শক্তিশালী। কংগ্রেস সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হলেও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ নিয়ে কংগ্রেসের সাথে বাংলার জনগনের ও রাজনৈতিক নেতাদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ফলে ধীরে ধীরে বাংলায় কংগ্রেস জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গ রদ ও সলিমুল্লাহর মৃত্যুর কারণে বাংলায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পরে। তাই বাংলায় মুসলিম লীগের জয়ের প্রধান বাধা হয়ে দাড়ায় কৃষক প্রজা পার্টি। মুসলিম লীগ বাংলায় তাদের তুলনামূলক কম জনপ্রিয়তা আঁচ করতে পেরে কৃষক শ্রমিক পার্টির সাথে জোট গঠনের চেষ্টা করে। মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় পর কৃষক শ্রমিক পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে জিন্নাহর মুসলিম লীগ ও সোহরাওয়ার্দীর ইউনাইটেড মুসলিম লীগ জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। ফলে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলায় কংগ্রেসের অজনপ্রিয়তার কারণে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মূল প্রতিযোগিতা হবে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্য।
কৃষক প্রজা পার্টির ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের কর্মসূচী
কৃষক প্রজা পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে অতিসত্বর নির্বাচনী কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। কৃষক প্রজা পার্টি ফজলুল হককে সভাপতি ও রজব আলী তরফদারকে সেক্রেটারি নিযুক্ত করে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করে। কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে কৃষক প্রজা পার্টি বাংলার জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। কৃষক প্রজা পার্টি মোট ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এগুলো হলো: ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারি প্রথা বিলোপ, প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন, খাজনা ও ঋণ মওকুফ, নজর-সেলামি-আবওয়াব বাতিল, মহাজনী আইন বাতিল, কৃষকদের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ চালু, খাল খননের মাধ্যমে সেবা সুবিধা সৃষ্টি, প্রতি থানায় হাসপাতাল স্থাপন, পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, শাসন ব্যয় হ্রাস, মন্ত্রিদের বেতন ১০০০ টাকা নির্ধারণ, সব নিষ্পেষণমূলক আইন বাতিল ও রাজবন্দিদের মুক্তি, ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করে বার্ষিক ৪ ভাগ হারে ঋণ প্রদান ও পাট চাষে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পাটের সর্বনিন্ম দাম নির্ধারণ।
১৯৩৭ এর নির্বাচনে অন্যান্য দলের কর্মসূচীর সাথে কৃষক প্রজা পার্টির কর্মসূচীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় মূল লড়াই হয়েছে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে। এই নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই চেষ্টা করেছে ভিন্ন কর্মসূচী দিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করার। তবে সকল রাজনৈতিক দলকে ছাপিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি তাদের কর্মসূচীতে বেশ নতুনত্ব নিয়ে আসে। সকল রাজনৈতিক দলই কৃষক প্রজাদের নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও শুধু কৃষক প্রজা পার্টিই বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের অঙ্গীকার করে। মুসলিম লীগ ধর্মের দোহাই দিয়ে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিরোধিতা করে। একদিকে কৃষক প্রজা পার্টি ‘সকলের জন্য ডাল ভাতের ব্যবস্থা’, ‘লাঙ্গল যার জমি তার’, ‘ঘাম যার দাম তার’ শ্লোগানের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ইসলামকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক পন্থায় প্রচারণা চালাতে থাকে। এমনকি মুসলিম লীগের পক্ষে দৈনিক আজাদ, স্টার অব ইন্ডিয়ার মতো সংবাদপত্র প্রচারণা করে এবং মুসলিম লীগের অধিকাংশ প্রার্থী অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার প্রচারণায় ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সুবিধা লাভ করে। কৃষক প্রজা পার্টি তাদের ভুমির খাজনা হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল, আবওয়াব-নজর-সেলামি বিলোপসহ নানা যুক্তিযুক্ত দাবি জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরে। এছাড়া ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কৃষক প্রজা পার্টিকে অনেক সাহায্য করে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ কৃষক প্রজা পার্টিকে মুসলমান বিরোধী ও কংগ্রেসের অনুগত বলে প্রচার করে। আবার হিন্দু মহাসভাও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে কংগ্রেসের পক্ষে জনমত আদায়ের চেষ্টা করেছে। এক কথার বলতে গেলে মুসলিম লীগের তুলনায় জনসংযোগের দিক দিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি এগিয়ে ছিল।
১৯৩৭ এর নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির চমক
১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় বিধান সভা নির্বাচনে চমক দেখায় কৃষক প্রজা পার্টি। বঙ্গীয় বিধান সভা নির্বাচনে ১১৭ টি সংরক্ষিত মুসলিম আসনের মধ্যে কৃষক প্রজা পার্টি পায় ৩৬ টি আসন, যা প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩০.৭৬ ভাগ। অন্যদিকে মুসলিম লীগ পায় ৩৫ টি আসন, যা মোট ভোটের ২৯.৯১ শতাংশ। যদিও বিশেষ স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করার কারণে মুসলিম লীগ বরাদ্দকৃত আরও ৪ টি আসনসহ মোট ৩৯ টি আসন লাভ করে। আর স্বতন্ত্র ৪১ জন প্রার্থী জয়লাভ করে যা মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৫.০৪ শতাংশ। অপেক্ষাকৃত নবীন দল হয়েও কৃষক প্রজা পার্টি গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের চেয়ে ভালো ফলাফল করে। এমনকি খুলনা, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালী, ময়মনসিংহের সব কয়টি আসন পায় কৃষক প্রজা পার্টি। তবে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ থেকেই বোঝা যায় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনের আগে তৃণমূলে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। তবে যাই হোক, সার্বিক বিবেচনায় নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে কৃষক শ্রমিক পার্টির ৩৫ আসন পাওয়া সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। পরবর্তীতে ৩৭ জন স্বতন্ত্র মুসলিম আসনের সদস্যদের মধ্যে ২১ জন মুসলিম লীগে, ১৬ জন কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেয়। পরিশেষে বঙ্গীয় বিধান সভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০, মুসলিম লীগ ৫৯ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি ৫৫ আসনের মালিক হয়।
ফজলুর হকের মন্ত্রিসভা গঠন ও এর কার্যক্রম
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই কোয়ালিয়েশন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রয়োজন হয়। প্রথমে বাংলার গভর্নর শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বঙ্গীয় কংগ্রেস সভাপতি শরৎ বসুকে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব জানায়। শরৎ বসু প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রন জানানো হয়। মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রন পেয়ে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির ২ জন, মুসলিম লীগের ৪ জন, সংখ্যালগু হিন্দু ও তফসিলি সম্প্রদায়ের ৫ জনকে নিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। সেই মন্ত্রিসভায় ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং এতে ৬ জন মুসলমান ও ৫ জন হিন্দু নেতা থাকেন। এছাড়াও গোষ্ঠী হিসেবে চিন্তা করলে এতে ৬ জন জমিদার, ১ জন পুঁজিপতি, ৪ জন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
হক মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল, মত ও পেশার মানুষ থাকায় প্রথম থেকেই সেই মন্ত্রিসভা আদর্শগত ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে। এর ফলে কৃষক প্রজা পার্টির জনগনের কাছে নির্বাচনে দেয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাধা পেতে থাকে। এইসব সমস্যা অবলোকন করে ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণতা আনার জন্য কৃষক প্রজা পার্টির পাশাপাশি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবেও যোগদান করে। ফজলুল হক মন্ত্রিসভা জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে কমিটি গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হয়। এছাড়াও চাষি খাতক আইনের আয়তায় ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন ও মহাজনি আইন পাস করে মহাজনদের ট্রেড লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করেন। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা সম্প্রদায়ভিত্তিক বণ্টনবিধি অনুযায়ী চাকরিতে ৫০ ভাগ পদ মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট করে। এছাড়াও এই মন্ত্রিসভা বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইন পাস, দোকান কর্মচারী আইন পাস, পল্লী সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার ও রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়ে বাংলায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
কৃষক প্রজা পার্টির পতন
মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিয়েশন সরকার গঠনের কারণে প্রথম থেকেই ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টির বিদ্রোহী অংশের সমালোচনার মুখে পরে। অন্যদিকে যে ফজলুল হক নিজে দীর্ঘ সময় ধরে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করেছেন সে নিজেই তার মন্ত্রীসভায় ৬ জন জমিদারকে নিযুক্ত করেছিলেন। আবার তিনি তার দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগে যোগদান করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফজলুল হকের একইসাথে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালনের কারণে মন্ত্রীসভা কতটুক প্রাণবন্ত হয়েছিল সে আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু এতে করে যে কৃষক শ্রমিক পার্টি সাংগঠনিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। যেহেতু ফজলুল হক ছিল কৃষক প্রজা পার্টির প্রধান অভিভাবক, তাই মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে যোগদান করার পর কৃষক প্রজা পার্টি প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে। ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা কৃষক প্রজা পার্টির নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেয়ে মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। ফজলুল হকের একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পরে যখন কৃষক শ্রমিক পার্টির বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে তখন ফজলুল হক অনেকটা মুসলিম লীগের দিকে ঝুঁকে পরতে থাকে। একদিকে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ জনপ্রিয় হতে থাকে, অন্যদিকে ফজলুল হকের অনুস্পস্থিতিতে কৃষক প্রজা পার্টি দুর্বল হতে থাকে। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর বাংলায় মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ আরও বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে।
১৯৪০-৪১ সালে মুসলিম লীগ কেন্দ্রের সাথে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের বিরোধিতার জেরে জিন্নাহ ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করে এবং ১৯৪১ ফজলুল হক হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রোগ্রেসিভ পার্টি গঠন করেন। অন্যদিকে ফজলুল হকের অনুপস্থিতি, নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে না পারা, সাংগঠনিক স্থবিরতা, নেতৃত্ব সংকট ইত্যাদি কারণে কৃষক শ্রমিক পার্টি নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে। যদিও ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় কৃষক প্রজা পার্টির ১৯ জন সদস্য ও ২ জন মন্ত্রী ছিল, তবুও রাজনৈতিক মাঠে কৃষক প্রজা পার্টি ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পরে। যার প্রমাণ, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি লাভ করে নামমাত্র ৪ টি আসন। পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫৩ সালে দলটির নাম পরিবর্তন করে কৃষক শ্রমিক পার্টি রাখা হয় এবং যুক্তফ্রন্টের অধীনে ‘৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু আগের গণমানুষের দল হিসেবে যে কৃষক প্রজা পার্টি ছিল, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাংলার ইতিহাসে কৃষক প্রজা পার্টি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনায় কৃষক প্রজা পার্টির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বাংলার কৃষকদের তিলে তিলে শেষ করে দেয়া জমিদারী প্রথা নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যখন উদাসীন ছিল তখন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টিই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা জমিদারী প্রথার প্রতিবাদ জানিয়ে এই প্রথাকে উচ্ছেদের সংকল্প করেছিল। অন্যদিকে এই দলে প্রথম সারির নেতাদের বেশিরভাগই ছিল নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। ফলে তারা কৃষক, শ্রমিক, অবিহেলিত মানুষের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। তাই তারা খুব সহজেই গ্রামীণ কৃষক, শ্রমিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদেরকে তাদের দলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলেন। অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক পার্টিতে মুসলিম নেতাদের আধিক্য থাকলেও দলটি ছিল মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনার।এমনকি দলে জে.এল. ব্যানার্জী ও নরেশ সেন গুপ্তর মতো হিন্দু নেতাও ছিল। এছাড়াও দলে আবদুল করিম, মুজিবর রহমান, আবদুল মুমিনের মতো পশ্চিমবঙ্গের নেতা এবং এ কে ফজলুল হক, শামসুদ্দিন আহমেদ, তমিজুদ্দিন খান, আবদুর রহিমের মতো পূর্ববঙ্গের নেতা ছিল। ফলে সমগ্র বাংলায়ই দলটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে একমাত্র প্রাদেশিক দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে ভোট ব্যাংকের খেলায় চমক দেখায়। মোটা দাগে বলতে গেলে, তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুনত্ব ও চমক নিয়ে এসেছিল ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি। কিন্তু দলটি নেতৃত্ব সংকট, দূরদর্শিতার অভাব ও জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে হয়তো খুব বেশীদিন রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি।কিন্তু দলটি যতদিন সময় বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, ততদিনই দলটি বাংলায় গণমানুষের মৌলিক দাবি নিয়ে অন্তরিকভাবে কাজ করেছে।
Feature Image Courtesy: kalerkantho.com
Reference Books:The Foreshadowing Of Bangladesh; Harun-or-Rashid
Muslim Polities in Bengal, A Study of Krishok Proja Party and the Elections of 1937; Humaira Momen
The Muslim Political Parties in Bangladesh 1936-1947; Mohammad Seraj Mannanবাংলার স্ব শাসন; এনায়েতুর রহিম
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস; এম. এ. রহিম